সিগারেটের ওপর কর আরোপে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়েস শিকাগোর (ইউআইএস) হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে আসে। টোব্যাকোনমিকস প্রথমবারের মতো সিগারেট করনীতির কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে ইন্টারন্যাশনাল সিগারেট ট্যাক্স স্কোরকার্ড প্রকাশ করেছে। এই গবেষণায় বাংলাদেশসহ ১৭০টিরও বেশি দেশ রয়েছে।
গবেষণায় বাংলাদেশের প্রাপ্ত স্কোর ২.৩৮ (৫ এর মধ্যে), যা বৈশ্বিক গড় স্কোরের (২.০৭) চেয়ে সামান্য বেশি। তবে সিগারেটে করারোপের ক্ষেত্রে যেসব দেশ খুব ভালো স্কোর (৪.৬৩) করেছে তাদের তুলনায় বাংলাদেশের এখনও অনেক উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে।
সবচেয়ে বেশি স্কোর পাওয়া দুটি দেশ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। দেশদুটিতে সিগারেটের ওপর উচ্চহারে সুনির্দিষ্ট একক এক্সাইজ কর চালু থাকায় এবং নিয়মিতভাবে তা বৃদ্ধি করায় সিগারেটের সহজলভ্যতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
সিগারেট করনীতির স্কোর এ ২০১৪ সালের (০.৮৭৫) তুলনায় ২০১৮ সালে (২.৩৮) বাংলাদেশের কিছুটা অগ্রগতি হলেও সিগারেটের দাম ও করকাঠামোর দিক থেকে বাংলাদেশের তেমন কোনো অগ্রগতি নেই বললেই চলে। উভয় ক্ষেত্রেই মাত্র ১ স্কোর পেয়েছে বাংলাদেশ। বহু স্তরবিশিষ্ট অ্যাডভেলোরেম করকাঠামো এবং ভিত্তিমূল্য খুব কম থাকাই এর অন্যতম প্রধান কারণ।
জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘সিগারেটের বিদ্যমান জটিল মূল্যস্তর প্রথা বাংলাদেশের স্কোর কম পাওয়ার অন্যতম কারণ। বাংলাদেশে সিগারেটে করারোপের ক্ষেত্রে বহুস্তর বিশিষ্ট মূল্যস্তর প্রথা বিলুপ্ত, সুনির্দিষ্ট করপদ্ধতি প্রবর্তন এবং সর্বোপরি জীবন বাঁচাতে, ক্যানসারসহ তামাকজনিত রোগের প্রকোপ কমাতে ও প্রয়োজনীয় রাজস্ব আহরণের জন্য সমস্ত তামাকজাত পণ্যের ওপর বিদ্যমান সম্পূরক শুল্ক উল্লেখযোগ্যহারে বাড়াতে হবে।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর বলেন, তামাকজাত পণ্যের কর বৃদ্ধি করা হলে এর ব্যবহার কমে এবং সরকারের বাড়তি রাজস্ব আয় অর্জন সম্ভব হয়। অতিরিক্ত এই অর্থ সরকার করোনা মহামারি সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ব্যয় এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যয় করতে পারবে।’
তামাকপণ্যে সুনির্দিষ্ট কর পদ্ধতি প্রবর্তন, সিগারেটে দুটি মূল্যস্তর এবং সিগারেটের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বহু বছর ধরে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো। এছাড়াও তামাকপণ্যের খুচরা মূল্যের ওপর ৩ শতাংশ সারচার্জ আরোপের দাবি জানা্চ্ছে সংগঠনগুলো। কিন্তু সরকার বরাবরের মতো এবারও তা আমলে নিচ্ছে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০১৮ সালের তথ্যমতে, বিশ্বের ১৫৭টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কমদামে সিগারেট পাওয়া দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০২তম এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিয়ানমারের পরেই বাংলাদেশে সবচেয়ে কম দামে সস্তা ব্রান্ডের সিগারেট পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য আরও সস্তা।
গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সারভের (জিএটিএস) ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তামাকের সহজলভ্যতাই এর প্রধান কারণ। কম দামে তামাকপণ্য কেনার সুযোগ এবং ত্রুটিপূর্ণ করকাঠামো বিশেষ করে সিগারেটে ৪টি মূল্যস্তর থাকায় বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার কমছে না। তামাকের দাম বেশি হলে তরুণ জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার শুরু করতে নিরৎসাহিত হয় এবং তামাক আসক্তরাও বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী তামাক ছাড়তে উৎসাহিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসি না ২০৪১ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ জন্য করকাঠামো বদলানোর পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।তবে বাস্তবে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। বিগত বাজেটে সিগারেটের দাম বাড়ানো এবং বাড়তি কর বসানোর পরিকল্পনা থাকলেও সরকার সেখান থেকে পিছিয়ে আসে। অর্থমন্ত্রণালয় ব্যর্থতা স্বীকার করে তখন জানিয়েছিলেন, সিগারেটের মূল্য স্তর চারটি থেকে কমিয়ে দুটিতে নিয়ে আসার বিষয়ে অনেক ভাবা হয়েছে। কিন্তু এখনই তা সম্ভব হচ্ছে না। পরে এর নানা দিক বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এসডব্লিউ/কেএইচ/০৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ