মহামারীর সঙ্কটের মধ্যে চলতি অর্থবছরের বাজেটে অর্থনীতির মূলস্রোতে অর্থ প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে আয়কর অধ্যাদেশে দুটি ধারা সংযোজন করা হয়। এতে ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। সেই সুযোগ নিয়েই কালো টাকা সাদা করার হিড়িক পড়েছে। যাকে ‘অভূতপূর্ব’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এনবিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
সেখানে বলা হয়, “অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও পুঁজিবাজারের উন্নয়নে চলতি অর্থবছর সরকার কালো টাকা বিনিয়োগে বিশেষ সুযোগ দেয়। এ সুযোগে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছেন করদাতারা।”
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) মোট ৭ হাজার ৬৫০ জন এই সুযোগ নিয়েছেন। শুধু ডিসেম্বর মাসেই ৪ হাজার ২৯২ জন কালোটাকা সাদা করেছেন। এর মধ্যে ২০৫ জন করদাতা ২২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অনুমোদিত সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করেছেন। আর ৭ হাজার ৪৪৫ জন করদাতা ৯৩৯ কোটি ৭৬ লাখ কালো টাকা সাদা করেছেন। তাদের সবাইকেই নির্দিষ্ট হারে আয়কর দিতে হয়েছে। তারা ১০ হাজার ২২০ কোটি কালো টাকা সাদা করায় সরকার মোট ৯৬২ কোটি ৬০ লাখ টাকা কর পেয়েছে।
এনবিআর বলেছেন, “এর ফলে দেশের ফরমাল ইকনোমিতে ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা প্রবেশ করেছে, যা বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং কর জিডিপির হার বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।”
আরো বলেন, চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর করদাতা বেড়েছে ৯ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে বলা হয়েছিল, দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক না কেন ১ জুলাই ২০২০ থেকে ৩০ জুন ২০২১ পর্যন্ত ব্যক্তি শ্রেণির করদাতারা আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের উপর প্রতি বর্গমিটারের উপর নির্দিষ্ট হারে এবং গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্য কোনো সিকিউরিটিজের উপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করলে আয়কর কর্তৃপক্ষ বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না।
এর পাশাপাশি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে বাজেটে বলা হয়েছিল, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম চালিকাশক্তি পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে তিন বছরের লক-ইনসহ কতিপয় শর্তে ১ জুলাই ২০২০ থেকে ৩০ জুন ২০২১ পর্যন্ত ব্যক্তি শ্রেণির করদাতা পুঁজিবাজারে অর্থ বিনিয়োগ করলে এবং ওই বিনিয়োগের উপর ১০ শতাংশ কর দিলে আয়কর কর্তৃপক্ষ বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না।
এবারের মতো এমন ঢালাও সুযোগ আর তেমন একটা আসেনি। জমি, ফ্ল্যাট কেনা, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে কিংবা ব্যাংক বা নিজের কাছে নগদ টাকাও সাদা করার ঢালাও সুযোগ দেওয়া হয়। ফলে বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখা টাকাও সাদা করার সুযোগ মিলেছে। কালোটাকা সাদা করলে অর্থের উৎস জানতে চাইবে না এনবিআর। এমনকি অন্য কোনো কর্তৃপক্ষও এই সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভয়ে যারা এত দিন কালোটাকা সাদা করেননি, তারা এবার এই সুযোগ হাতছাড়া করেননি।
এই সুযোগ ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বলবৎ আছে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
এনবিআরের এই ধরনের কাজের সমালোচনা করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, ‘এনবিআর হয়তো কিছু টাকা কর পেয়েছে বলে আত্মতুষ্টিতে ভুগছে। কিন্তু সংবিধানে এই ধরনের আয়কে সুস্পষ্টভাবে অবৈধ বলা হয়েছে। এনবিআরের মনোভাব হলো—চুরি করেন, তারপর আমাদের কাছে আসেন, আমরা তো আছি’। এনবিআর কালো টাকা সাদা করার কৌশল খাটিয়ে যে কর আদায় করছেন সেটাও এক ধরনের কালো টাকাই বলে মন্তব্য করেন তারা। এনবিআর এবং কালো টাকাধারীদের মধ্যকার তেমন কোনো তফাৎ রইলো না বলেও মনে করেন তারা। তারা মনে করেন, এই ধরনের সুযোগ দেওয়ার বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা বা যে ব্যাখ্যা দেওয়া হোক না কেন, তা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এতে অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে, আর সৎ করদাতাদের কর দেওয়ায় নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এই ধরনের সুযোগ বন্ধ করার দাবি জানান তারা।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৮
আপনার মতামত জানানঃ