সুমিত রায়
সর্বোচ্চ মজুরি স্থাপনের ইতিহাস সর্বনিম্ন বা ন্যুনতম মজুরি স্থাপনের ইতিহাসের চেয়েও পুরনো। সেখানেই আগে যাওয়া যাক। জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি একটি দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। ব্ল্যাক-ডেথ ও দুর্ভিক্ষের বিপর্যয়ের পূর্বে ১২শ ও ১৩শ শতকে ইউরোপের বাণিজ্য ও উৎপাদন বেড়ে গিয়েছিল, তাই ইউরোপে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রান্তিক জমিতে চাষ বসানাে হয়, কিন্তু সেখানে উৎপাদন কম হয়। এদিকে জনসংখ্যা বাড়লেও খাদ্যশস্য ও চাষজমির যােগান তেমন না বাড়ায়, এদের চাহিদা বেড়ে যায়, আর তার ফলে পশ্চিম ইউরোপে বাড়ে খাদ্যশস্যের দাম। খাদ্য শস্যের পরিমাণ কমে যাওয়ায় লাভ তুলে নিতে সামন্তপ্রভুরা খাজনা বাড়ায়, কৃষকের কাঁধে অনেক কর চাপায়, ফলে কৃষকদেরকে বাধ্যতামূলক শ্রম দান করতে হত। এসবের ফলে কৃষকের অবস্থার অবনমন ঘটে, অধিক খাজনা নিয়ে সামন্তপ্রভুদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। কিন্তু ১৪শ শতকে এই ধারার পরিবর্তন হওয়া শুরু করে। এই সময়ে সারা ইউরোপ জুড়ে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে (বন্ড ইভেন্ট) দুর্ভিক্ষ আর প্লেগ চলে আসে, বলতে গেলে এই দুটো একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। এই বিপর্যয়ে বহু লােক মারা গেলে ইউরোপের জনসংখ্যা হ্রাস পায়। তদকালীন সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার অন্যতম উপকরণ ছিল ভূমিদাস কৃষক, কিন্তু বিপর্যয়ের ফলে প্রচুর ভূমিদাস মারা গেলে, অর্থাৎ উৎপাদনের এই অন্যতম উপকরণের সরবরাহ কমে গেলে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন কমে আসে, মন্দা দেখা যায়। এটা মনে করার কারণ নেই যে উৎপাদনও কমেছে, আবার মানুষ মরার ফলে ভোক্তাও কমেছে, তাই সব কিছুতে ব্যালেন্স আছে। এমনটা ছিলনা। এর ফলে কৃষিজমি ও খাদ্যশস্যের চাহিদা কমে, তাই এগুলোর দামও কমে। ফলে খাজনার পরিমাণও যায় কমে। এদিকে কৃষিজমির তুলনায় ভূমিদাসের পরিমাণ অনেক কমে গেলে ভূমিদাস বা শ্রমের চাহিদা বেড়ে যায়, অর্থাৎ ভূমিদাসের শ্রমের দাম বা মজুরি বেড়ে যায়। শ্রমের দাম বাড়ায় ভূমিদাসের আয় বাড়ে, ফলে কৃষকদের স্বাধীনতাও বেড়ে যায়। তাই কৃষকের অবস্থার উন্নয়ন হয়। কৃষকের স্বাধীনতা তদকালীন ভূমিদাসপ্রথা ও সামন্ততন্ত্রে একরকম আঘাত সৃষ্টি করে। ভূমিদাসদের শ্রমের মজুরি বাড়ে, কিন্তু খাজনা বাড়েনি। এর ফলে ভূস্বামীরা সংকটে পড়েন, রাজস্বের পরিমাণ কমে যায়, রাজকোষে টান পড়ে। তাছাড়া ভূস্বামীদের আয় কমে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের মধ্যে সংঘাত, যুদ্ধবিগ্রহ বৃদ্ধি পায়, ফলে তাদের ব্যয়ও বেড়ে যায়।
যাই হোক, সামন্তপ্রভূদের অবস্থা খারাপ হলে তারাও বিকল্প উপায়ে লাভের চেষ্টা করে। পশ্চিম ইউরােপের ভূস্বামীদের মুনাফা কমে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই তাদেরকে এই সময়ে ক্রীতদাস দিয়ে চাষ করিয়ে মুনাফার পরিমাণ বজায় রাখার চেষ্টা করতে দেখা যায়। পর্তুগাল ও স্পেনের ভূস্বামীরা ক্রীতদাস দিয়ে চাষবাস শুরু করেছিল। আবার যেখানে ভূমিদাসদের মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অধিক, সেখানে ভূস্বামীরা তাদের কৃষিজমিকে বাধ্য হয়ে পশুচারণ জমিতে পরিণত করে মেষপালন শুরু করেন। এর কারণ ছিল দুটি – প্রথমত, রাজস্ব অনেক কমে গেছে, খাদ্যশস্যের দামও পড়ে গেছে, তাই কৃষিকাজের চেয়ে মেষপালনে লাভের সম্ভাবনা বেশি, দ্বিতীয়ত মেষপালনে কৃষিকার্যের চেয়ে কম শ্রমিক লাগে, জনসংখ্যা কম হয়ে যাওয়ায় তাই স্বল্পসংখ্যক শ্রমিক দিয়ে পশুপালনই সুবিধাজনক ছিল। এদিকে জনসংখ্যা হ্রাসের ফলে মজুরি বৃদ্ধি ও খাদ্যশস্যের দাম কমে আসায় লাভ কমে যাওয়ায়, এবং উৎপাদন কমে আসায় ভূস্বামীরা ভূমিহীন কৃষক দিয়ে অথবা পরে যারা খুব ছােটখাটো ক্ষেতখামারে কাজ করতে বাধ্য ছিল এমন কৃষকদের সাহায্যে কৃষি উৎপাদন চালু রাখতে সচেষ্ট হন। কিন্তু বারবার মহামারীর প্রকোপে এই সব কৃষকদের মধ্যেও মত্যুর হার বৃদ্ধি পেতে থাকলে ভূস্বামীরা পুনরায় বিপদে পড়েন। শর্তাধীন-কৃষি-উৎপাদন বহু অঞ্চলেই বন্ধ হয়ে যায় এবং জমির মালিকেরা অতি অল্প বার্ষিক খাজনার বিনিময়ে সেই সব জমিতে শস্য উৎপন্ন করতে আগ্রহান্বিত হয়ে ওঠেন। অবশ্য ব্ল্যাকডেথের আগেও কোথাও কোথাও বার্ষিক খাজনার বিনিময়ে জমির বন্দোবস্তের কথা জানা যায়। বেলিফরা প্রায়ই খাস-সম্পত্তির অবস্থা অনুযায়ী এই ব্যবস্থা নিতেন আর এই প্রথা আইন-সঙ্গতও ছিল। কিন্তু ব্ল্যাকডেথের পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলেও কৃষকদের এই সব সুবিধাগলি বাতিল করা কঠিন হয়ে যায়।
যাই হোক, ভূস্বামীরা সংকটে পড়লে ও তাদের আয় কমে এলে তারা বাধ্য হয়ে তাদের খাস জমি অর্থের বিনিময়ে কৃষকদেরকে লিজ বা ইজারা দান করে। আগেই অর্থনৈতিক মন্দার কারনে রাজস্ব কমে গিয়েছিল, জমি ইজারা দানের ফলে তা আরও কমে যায়। রাজস্ব কমে যাওয়ায় ও রাজকোষে টান পড়লে কৃষকদের উপর নতুন করে অনেক করারোপ ও শোষণ করা শুরু করে। কিন্তু কৃষকরা তা আর মানতে চায়নি, পূর্বের অবস্থায় ফিরতে চায়নি। ফলে অসন্তোষ দানা বাঁধে, অনেকে পালিয়ে নগরে গিয়ে কারিগরি পেশা বেছে নেয়, আবার অনেক কৃষক একত্রে মিলে কৃষক-বিদ্রোহের সূচনা করে। অনেক ক্ষেত্রে এইসব বিষয় তদকালীন সমাজে কৃষকের অবস্থা, ভূস্বামীদের অবস্থায় পরিবর্তন সৃষ্টি করে, সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় ফাঁটল ধরায়। যাই হোক, এর সম্মিলিত ফল ছিল সামন্ততন্ত্রের পতন ও আধুনিকতার বিকাশ। অনেকেই সেদিন আমার পোস্টে এসে বলেছিলেন যে আধুনিকতার বিকাশ ও সামন্ততন্ত্রের পতনে দুর্ভিক্ষ ও ব্ল্যাকডেথের ভূমিকা নেই, এটা তাদের প্রতি আমার উত্তর।
কিন্তু এটা আজকের আলোচনার বিষয়না। কন্টিনিউ করা যাক। এই সময় বিভিন্ন স্থানে কৃষকদের অবস্থার তুলনামূল উন্নয়ন দেখা গেলেও কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ ও কৃষকবিদ্রোহও লক্ষ্য করা যায়। এর একাধিক কারণ ছিল। প্রথমত, কৃষিব্যবস্থার পরিবর্তন কৃষকদেরকে তাদের শ্রমের মূল্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। শর্ত বা জমির বিলিবন্দোবস্ত পছন্দ না হলে স্থানান্তরে অধিকতর সুবিধাজনক শর্তসাপেক্ষে তারা ক্ষেত-খামারে কাজ করার জন্য প্রস্তুত থাকতো। বহু অঞ্চলে ভূস্বামীরা এই প্রতিকূল পরিস্থিতি রাজশক্তির সাহায্যে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করেছিল। ঠিক এই পরিস্থিতিতেই ইতিহাসে প্রথমবারের মত জারি করা হয় শ্রমিকের সর্বোচ্চ মজুরি। ইংল্যান্ডে ১৩৪৯ সালে শ্রমিক-সংক্রান্ত এক আইনের সাহায্যে মজুরী স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা হয়। ইংল্যান্ডে রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডের জারি করা Ordinance of Labourers (1349) বা শ্রমিকদের অধ্যাদেশ (১৩৪৯)-এই এই প্রথম সর্বোচ্চ মজুরির ইতিহাসটা পাওয়া গেল। এখানেই প্রথমবারের মতো শ্রমিকদের জন্য সর্বোচ্চ মজুরি নির্ধারণ করা হয়। আর কয়েক বছর পরে ফরাসীরাজ দ্বিতীয় জনও অনুরূপ এক বিধান জারী করেন। বাজার যেখানে রাষ্ট্রের বা শোষক শ্রেণীর স্বার্থের বিরুদ্ধে সেখানে শ্রমের অনেক চাহিদা ও মূল্য থাকলেও যাতে শ্রমিকরা বেশি মজুরি না নিতে পারে তার জন্য একটা আইন বেধে দেয়া হলো।
কিন্তু কথা হলো, এর ফল কী ছিল? মহামারীর ফলে উদ্ভুত নতুন অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি কৃষকদের সামনে যে বাড়তি সুযােগ-সুবিধা এনে দিয়েছিল আইনের সাহায্যে তাকে নষ্ট বা হ্রাস করার চেষ্টা তাদের অসন্তোষ বৃদ্ধি করেছিল মাত্র। জনসংখ্যা হ্রাসের ফলে অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি হলে ও ভূস্বামীরা সংকটে পড়লে তারা কৃষকদের খুব কম বার্ষিক খাজনার শর্তে কাজ করিয়ে উৎপাদন টিকিয়ে রাখতে চায়। তারা আর শর্তহীনভাবে বেগার খাটত না। বিপর্যয়ের অবস্থার পরিবর্তনের পর তারা আর পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে চায়নি। দ্বিতীয়ত, গ্রামাঞ্চলে কৃষি শ্রমিকদের সংখ্যা উল্লেখযােগ্যভাবে হ্রাস পাওয়ায় অনেক সামন্তপ্রভু কৃষি-শ্রমিক এবং সার্ফদের মুক্তিদান কার্যত স্থগিত রেখেছিলেন, কারণ তারা যেনতেন প্রকারে কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে চাইছিলেন। কিন্তু এর জন্য তারা যথােপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতে পারতেন না। তাদের মজুরি দেওয়ার সামর্থ্যই ছিল না। ভূমিদাসরা একে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নেয়নি, তারা বিদ্রোহ করেছিল। তৃতীয়ত, ইউরােপের জনসংখ্যা কমলেও অনেক ক্ষেত্রেই অভিজাততন্ত্র এই পরিস্থিতিতে তাদের করের হার ও নিয়ন্ত্রণ কমায়নি। কিন্তু কৃষকদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় তাদের কাছ থেকে আগের হারে ভূমিরাজস্ব ও অন্যান্য কর আদায় করা সম্ভব হয়নি। সেসময় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে কৃষকের অভাব বাড়ায় যেমন মজুরি বৃদ্ধি পায়, তেমনি অভিজাততন্ত্রের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছিল। অভিজাতরা তাই আয় বাড়ানাের জন্য কৃষকদের ওপর মজুরি হ্রাস ও বাড়তি করের চাপ দেয়। ফলে ইউরােপের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। আবার বলছি, কৃষক-শ্রমিকদের মজুরি এভাবে নিয়ন্ত্রণ করার ফল দাঁড়ায় কৃষক বিদ্রোহে।
১৪শ শতকের ইউরােপের কৃষক বিদ্রোহগুলোর মধ্যে তিনটি খুব বিখ্যাত। প্রথমটি হল ১৩২৩-২৮ সালের মধ্যে সংঘটিত ফ্ল্যান্ডার্সের কৃষক বিদ্রোহ। ফ্ল্যান্ডার্স বা ফ্লাঁদর ছিল কৃষি ও শিল্পে উন্নত, এখানকার কৃষকদের ওপর শােষণ বাড়লে তারা বিদ্রোহ করেছিল। ১৩৫৭-৫৮ সালের ফ্রান্সের কৃষকরা বর্ধিত কৃষিকরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, তাদের সঙ্গে যােগ দিয়েছিল বণিক ও শিল্প-কারিগররা। এই কৃষক বিদ্রোহ ফ্রান্সে জ্যাকারি নামে পরিচিত। এই জ্যাকারি ছিল রক্তক্ষয়ী, কয়েক জন ভূস্বামী নিহত হন,বাড়িঘর লুণ্ঠিত হয়, সরকার শক্তি প্রয়ােগ করে এই বিদ্রোহ দমন করেছিল। ১৩৭৮ সালে ফ্লোরেন্সের কৃষকরা বিদ্রোহ করেছিল, ১৩৭৮-৮২ এর মধ্যে ঘেন্ট ও ব্রুজের তাঁতিরা বিদ্রোহ করেছিল। ঐতিহাসিকরা অনুমান করেছেন মধ্য ১৪শ শতকের এসব বিদ্রোহের ওপর মহামারীর প্রভাব ছিল। সামাজিক অস্থিরতা ও অশান্তি তখনাে শেষ হয়নি। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অপশাসন ও কর-ভার কৃষকদের বিদ্রোহের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ১৪শ শতকের সবচেয়ে বড়াে কৃষক বিদ্রোহ হল ইংলন্ডের ১৩৮১ সালের কৃষক বিদ্রোহ। এই কৃষক বিদ্রোহ ছিল ব্যাপক ও রক্তক্ষয়ী। কৃষকদের ওপর উচ্চহারে ভূমিকর বসানাে হলে কৃষকরা বিদ্রোহ করেছিল। সমকালীন মানুষ এই বিদ্রোহের বর্ণনা রেখে গেছেন। ভূস্বামীরা বাড়তি কর যেমন আদায় করেছিল, কৃষকদের ওপর পুরনাে অধিকার বজায় রাখার চেষ্টা করেছিল। কৃষকরা ভূমিদাসত্ব ও করভারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল, মজুরি বৃদ্ধি করতে বলেছিল। এই কৃষক বিদ্রোহগুলোর মধ্য দিয়ে মধ্যযুগের সামাজিক দুর্বলতার প্রকাশ ঘটেছিল। বিদ্রোহগুলো তাদের লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি, কিন্তু সামন্ত ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলোর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে তার অবসান দাবি করেছিল। জার্মানিতেও কৃষক অভ্যুত্থান ঘটেছিল। ১৩৯৫ সালের কাটালোনিয়ার কৃষক-বিদ্রোহও গুরুত্বপূর্ণ।
কিছু আঞ্চলিক ও প্রকৃতিগত বৈচিত্র্য থাকলেও এগুলির সাধারণ দাবিগুলো ছিল মজুরির অঙ্ক বৃদ্ধি, বেগার শ্রমের অবসান প্রভৃতি। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের দাবিদাওয়া সরকার কখনােই সহানুভূতির চোখে দেখেনি। ১৩৮০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের সরকার পনেরাে বছরের ঊর্ধ্বে প্রায় সবার ওপর সমহারে কর ধার্য করলে গরিব মানুষের দুর্দশা চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছােয়। এছাড়া ভূস্বামী শ্রেণির চাপের সামনে নতিস্বীকার করে সরকার Statute of Labour প্রণয়ন করে। এই আইনের দ্বারা তারা স্বল্প মাইনে দেওয়ার অধিকার অর্জন করে। কৃষক বিদ্রোহগুলো এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিল যে কৃষকেরা ব্ল্যাকডেথের পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে রাজি ছিল না। আর ভূস্বামীরাও এই বাস্তব সত্যটা মেনে নিতে বাধ্য হন যে তাদের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলির সমাধান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমেই হতে পারে। ম্যানর-প্রভুর ক্ষেতখামারে বেগার-খাটুনীর বিনিময়ে অর্থ দিয়ে অব্যাহতি পাওয়ার রেওয়াজ আগেই শুরু হয়েছিল, ব্ল্যাকডেথের পর তা সার্বজনীন হয়ে ওঠে। আর এই সময় থেকেই ব্যাপকভাবে বার্ষিক খাজনা দানের শর্তে কৃষকদের মধ্যে জমির বন্দোবস্ত করাও শুরু হয়ে যায়। ইংল্যান্ড, এবং ইল্ দ্য ফ্রান্স, নরমাঁদি সহ পশ্চিম ইউরােপের বহু দেশে ‘ভিল্যান টেনিওর’ (Villen tenure) প্রায় অবলুপ্ত হয়ে যায়। ভূস্বামী শ্রেণি পরবর্তীতে এই বিদ্রোহী কৃষকদের পুরােপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। এবং কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে তারা চাষিদের সঙ্গে একটা সমঝােতায় এসেছিল। যেমন উত্তর ইতালিতে তারা ভাগচাষ প্রথা চালু করেছিল। একে বলা হত ‘মেজাড্রিয়া’ (Mezzadria)। ইউরােপের কোনাে কোনাে দেশে আবার ভূস্বামীদের প্রাধান্য কিছুটা ক্ষুন্ন হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস প্রভৃতির কথা বলা যায়। এইসব দেশগুলিতে কৃষক কিছুটা সুবিধা আদায় করতে পেরেছিল। এগুলোই ছিল কৃষক-বিদ্রোহের ফল, ভূস্বামীরা ভূমিদাসদের সাথে সমঝোতায় আসতে বাধ্য হয়। অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে, সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘনিয়ে আসে।
আর এই সময়েই দেখা যায় আরেকটা প্রয়োজনের কথা। কৃষক-শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরি। নতুন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে অনেক ভূস্বামী স্বয়ম্ভরতার আদর্শ ছেড়ে দিয়ে ভূপ্রকৃতির আনুকূল্য অনুযায়ী ম্যানরের মধ্যে নিকটস্থ বাজারে চাহিদা আছে এমন কৃষিপণ্যের উৎপাদনে মনােনিবেশ করেন। ফলে কোনও কোনও ম্যানরের বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত্রে শুধু গম বা রাই (জই) বা পশুপালনক্ষেত্রে মাখন বা চীজ, অথবা দ্রাক্ষা উৎপাদনের সুবিধা থাকলে সুরা তৈরী আরম্ভ হয়ে যায়। ইউরােপে মুদ্রা নির্ভর অর্থনীতি (money economy) চালু হওয়ায় এই জাতীয় ভােগ্যপণ্য উৎপাদনের ব্যাপারে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের জন্য ভূস্বামীরা মজুরী দিয়ে দক্ষ শ্রমিক বা দিনমজুর নিয়ােগ করে চাষ শুরু করান। এতে শুধু যে তাদের মুনাফার আশা বৃদ্ধি পেত তাই নয়, ম্যানরের বহুবিধ শাসন-সংক্রান্ত দায় দায়িত্বের হাত থেকে তারা অব্যাহতি পেতেন। বড় বড় সামন্ত ম্যানরগুলোতে তখনাে বাধ্যতামূলক শ্রমদানের প্রথা ছিল। মাঝারি ও ছােটো আয়তনের জমিদারিগুলোতে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় ভাঙ্গন ধরেছিল। নাইট, জেন্ট্রি ও ছােটো ভূস্বামীরা সামন্ততান্ত্রিক অধিকারসমূহ বজায় রাখতে আর তেমন আগ্রহী ছিল না। এরা দিনমজুর দিয়ে চাষ করাতে বেশি আগ্রহী ছিল। অন্যদিকে বড় ম্যানরগুলি তখনও বেগার শ্রমদানকে আঁকড়ে ছিল এবং ম্যানর-অধিপতিরা তাদের অধিকারকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অসন্তোষ ও বিদ্রোহকে ত্বরান্বিত করেছিল। যাইহোক, পশ্চিম ইউরােপের বিভিন্ন স্থানে বিনিময়ের অর্থনীতি চালু হওয়া মাত্রই সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছিল এমন মনে করা ভুল। নতুন এই অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্যেও অন্তত কিছু কালের জন্য দাসত্ব, ভূমিদাসত্ব অথবা স্বাধীন কারিগর শ্রেণীর মানুষের ও শ্রমিকের সহাবস্থান সম্ভব ছিল। কিন্তু ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে যেমন বেশী মজুরির হার শ্রমিকদের স্থান ধেকে স্থানান্তরে যেতে প্রলুব্ধ করে, তেমনি ম্যানর-ছেড়ে-আসা প্রাক্তন ভুমিদাসদের আয়ত্তাধীন নাগরিক জীবনের বিভিন্ন সুখ-সুবিধা ম্যানরে থেকে যাওয়া ভূমিদাসদের উপর স্বাভাবিকভাবেই প্রভাব বিস্তার করে। এখানেই ১০ম-১১শ শতক থেকে ভূমিদাসদের অর্থের বিনিময়ে সামন্ততান্ত্রিক দায়-দায়িত্বের হাত থেকে অব্যাহতি পাবার প্রবল ইচ্ছার সূচনা হয়। পল সুইজি জানিয়েছেন যে দূর পাল্লার ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়লে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা সংকটের মধ্যে পড়ে। ম্যানরকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা দক্ষ ছিল না, এই উৎপাদন ব্যবস্থা ইউরােপের ক্রমবর্ধমান শহর ও গ্রামের চাহিদা মেটাতে পারেনি। এজন্য ভূমিদাস-নির্ভর কর্মশালাগুলো উঠে যেতে থাকে, শুরু হয় দিনমজুর নির্ভর কর্মশালার। নতুন ধরনের কর্মশালায় শ্রম বিভাজন ছিল (division of labour)। একজন শ্রমিক সুতাে কাটা থেকে বস্ত্রবয়ন সব কাজ করত না। ইউরােপের সামন্ত শ্রেণীর রুচি ও মানসিকতায় পরিবর্তন ঘটেছিল। তারা চেয়েছিল নতুন ধরনের ভােগ্যপণ্য। পুরনাে উপাদন ব্যবস্থা নতুন সামগ্রী উৎপাদনের জন্য যােগ্য ছিল না। ম্যানরগুলোর পক্ষে ভিন্ন-প্রকৃতির-উৎপাদন ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হয়ে যাওয়া সম্ভবপর ছিল না। বহুকাল ধরে একই ধরনের উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত থাকায় এবং শ্রমবিভাজনের ধারণা-বর্জিত হওয়ার ফলে তাৎক্ষণিক ভােগ ছাড়া বিনিময়ের জন্য পণ্য উৎপাদন সেখানে প্রায় অসম্ভব ছিল। তাছাড়া অধিকাংশ ম্যানরের আকৃতি তার সফল নিয়ন্ত্রণের অন্তরায় হয়ে উঠতো এবং ম্যানর-প্রভু ও কৃষিজীবী প্রজাদের বহু প্রাচীন রীতিনীতি, অধিকার ও দায়িত্বের গ্রন্থিলতার পরিবেশে মুনাফার জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের সম্যক ব্যবহার অসম্ভব ছিল। উৎপাদন ব্যবস্থার এই রক্ষণশীলতা, পরিবর্তনবিমুখতা বা নিরুপায়-নিশ্চলতাই (conservative and change-resisting character) সামন্ততন্ত্রকে অবলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছিল।
পুনশ্চ, কিভাবে দুর্ভিক্ষ ও ব্ল্যাক ডেথ সামন্ততন্ত্রের অবসান ও আধুনিকতার সূচনা ঘটিয়েছিল খেয়াল করুন। তবে এই ইতিহাস কেবল আধুনিকতার না, একই সাথে শ্রমিক শ্রেণীর সৃষ্টির ইতিহাস। এই প্রথম মানুষ ভূমিদাসত্ব ছেড়ে দিন মজুরির শ্রমজীবী পেশায় আসে। আর ঠিক এই অবস্থাতেই ধীরে ধীরে ন্যুনতম মজুরির ব্যাপারটা প্রাসঙ্গিক হতে শুরু করে। সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে, শান্তির ন্যায়বিচার, সর্বাধিক মজুরি নির্ধারণের জন্য অভিযুক্ত, এছাড়াও আনুষ্ঠানিক ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করতে শুরু করে। টেক্সটাইল শিল্পের শ্রমিকদের জন্য রাজা জেমস প্রথম দ্বারা ১৬০৪ সালে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের আইনটি পাস হওয়ার সাথে সাথে এই অনুশীলনটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু শ্রমিকের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে শ্রমিক বিক্ষোভের ইতিহাস। প্রথম বিক্ষোভ হলো আমেরিকার ভার্জিনিয়ার ব্রিটিশ কলোনিতে, স্কিল ওয়ার্কার পাঠানো হয়েছে, কিন্তু তাদের ভোটাধিকার নেই, রাজনীতিতে শ্রমিকদের রিপ্রেজেন্টেশনই নেই, তাই বিক্ষোভ হলো, আর সরকারও রাজি হলো তাদেরকে ভোটাধিকার দিতে। ১৬৬১ সালে আমেরিকার ভার্জিনিয়াতেই আবার শ্রমিক আন্দোলন। এবারেরটার কারণ ছিল যে, ওখানে কাজ করার জন্য যারা ইন্ডিচারড স্লেইভ হয়ে যেত তারা সপ্তাহে তিন দিন মাংস খেতে পারত, কিন্তু মেজোর গুডউইন এসে তাদেরকে ডায়েট থেকে মাংস বাদ দিয়ে দেয়, খালি কর্নব্রেড আর জল খেতে হবে। ফলে আবার বিক্ষোভ। এভাবেই আমেরিকার ব্রিটিশ কলোনিগুলো পরিণত হয় শ্রমিকদের বিক্ষোভ ও অধিকার আদায়ের দেশ, এরই ধারায় আরও একশো বছর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতা অর্জন করে। অধিকার আদায়ের ইতিহাস, আধুনিকতার ইতিহাস, মানবাধিকারের ইতিহাস আসলে ভূমিদাস ও শ্রমিকদেরই ইতিহাস।
এই ইতিহাসে ১৮শ শতকের আরেক মোর হলো ট্রেড ইউনিয়নের বিকাশ। শিল্প বিপ্লবের কথা আমরা কম বেশি সবাই জানি। এর ফলে ১৮শ শতকে ব্রিটেনে শিল্প সমাজের দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটে ও এর ফলে প্রচুর নারী, শিশু, কৃষক এবং অভিবাসী কাজের জন্য শহরে চলে আসে। ব্রিটেনে ১৫৭৪ সালেই সার্ফডম বা ভূমিদাসত্ব প্রথার বিলোপ ঘটে, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ ভূমি অভিজাতদের মালিকানাধীন এস্টেটে ভাড়াটে-কৃষক হিসেবেই রয়ে গিয়েছিল। এই রূপান্তরটি কেবল গ্রাম থেকে শহুরে পরিবেশে স্থানান্তরের মধ্যে একটি ছিল না; বরং, শিল্পের কাজের প্রকৃতি “শ্রমিক” এর একটি নতুন শ্রেণী তৈরি করে। একজন কৃষক জমিতে কাজ করতেন, পশুপালন করতেন এবং ফসল ফলাতেন, এবং হয় জমির মালিক ছিলেন বা ভাড়া দিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের উৎপাদিত একটি পণ্য বিক্রি করতেন এবং তার জীবন ও কাজের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতেই। কিন্তু শিল্প শ্রমিক হিসাবে শ্রমিকরা শ্রম হিসাবে তাদের নিজেদের শ্রম বিক্রি করে এবং নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে নির্দেশনা গ্রহণ করে, এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের স্বাধীনতা এবং স্ব-সংস্থা বা সেলফ-এজেন্সির একটি অংশ ছেড়ে দেয়। নতুন ব্যবস্থার সমালোচকরা এটিকে “মজুরি দাসত্ব” বা ওয়েজ-স্লেভারি বলে অভিহিত করবেন, কিন্তু যে শব্দটি তখনও অব্যাহত ছিল তা ছিল মানব সম্পর্কের একটি নতুন রূপ : কর্মসংস্থান বা এমপ্লয়মেন্ট। কৃষকদের মত শ্রমিকদের মধ্যে তাদের কাজের উপর নিয়ন্ত্রণ অত ছিলনা, তাদের চাকরির নিরাপত্তা তেমন ছিলনা, ছিলনা তাদের এমপ্লয়ারদের সাথে কোনরকম সম্পর্ক বা সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি। তাই তারা যে কাজটি সম্পাদন করেছিল তা তাদের স্বাস্থ্য ও জীবনে কিভাবে প্রভাব ফেলবে তা নিয়েও তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিলনা। ঠিক এই পরিস্থিতিতেই উদ্ভব হলো আধুনিক ট্রেড ইউনিয়নের।
শ্রমিকদের স্বার্থে তৈরি হওয়া এই ট্রেড ইউনিয়নগুলো স্বাভাবিকভাবেই তাদের এমপ্লয়ার ও সরকারী মহলের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে, তারা শত্রু হয়ে ওঠে। সেই সময়, এই ইউনিয়ন এবং ইউনিয়নিস্টদেরকে নিয়মিতভাবে বাণিজ্যে বাধাদান ও ষড়যন্ত্রমূলক আইনের অধীনে বিচার করা হতো। ট্রেড ইউনিয়নের অন্যতম কাজ ছিল কালেকটিভ বারগেইনিং বা সমষ্টিগত দরকষাকষি। তারা একত্রে মিলে শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে মালিকপক্ষের সাথে দর কষাকষি করত। ভূমি দাস বা শ্রমিকদের এই সমষ্টিগত দরকষাকষির ব্যাপারটা সেই ১৪শ শতকের ওই অর্ডিন্যান্সটির সময় থেকেই ছিল নিষিদ্ধ। যখন সর্বোচ্চ মজুরি নির্ধারিত করা হয়, তখনই এদের সমষ্টিগতভাবে দরকষাকষির ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়। কিন্তু রাষ্ট্র ঠিক করলেই তো হবেনা, সময়ের বিবর্তনে, সমাজের বিবর্তনে শ্রমিকরা আস্তে আস্তে ক্ষমতা অর্জন করতে থাকে। শ্রমিকদের ক্ষমতা বাড়তে বাড়তে তাদের কালেক্টিভ বারগেইনিং ও আর্লি ওয়ার্কার ইউনিয়নগুলোও বিকষিত হতে শুরু করে, আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোল্যুশনের সময় তা অনেকটাই বেড়ে যায়। ফলে সরকার গণবিক্ষোভের আশঙ্কায় এগুলোর বিরুধে অবস্থান নিতে শুরু করে, যা ঘটে বিশেষ করে ১৮০৩-১৫ সালের নেপোলেনিক যুদ্ধগুলোর সময়। ১৭৯৯ সালে একটি কম্বিনেশন অ্যাক্ট পাশ করানো হয়, যেখানে ব্রিটিশ শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন ও কালেক্টিভ বার্গেইনিং বা সমষ্টিগত দরকষাকষিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
এই প্রসঙ্গে সেই সময়ের লোকেদের আদর্শের কথা বলতে হয়। কেন তারা ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে নিষিদ্ধ করেছিল? ১৯শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, শ্রমিকদের সংবিধিগুলি বাতিল করা হয়েছিল কারণ ক্রমবর্ধমান পুঁজিবাদী যুক্তরাজ্য লাইসেজ-ফেয়ার বা মুক্ত বাজারের নীতিগুলি গ্রহণ করেছিল। আর এটি মজুরিকে বেঁধে দেয়া, সেটা সর্বোচ্চ মজুরিই হোক আর সর্বনিম্ন মজুরিই হোক, ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ করত না। সমগ্র ইউরোপ জুড়ে তখন চলছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতার হাওয়া, বাজার চলবে বাজারের নীতিতে, তাতে কোন রকম বন্ধন আসবে না, রাষ্ট্রও কোন হস্তক্ষেপ করবে না। এই প্রসঙ্গে হার্বার্ট স্পেন্সারের দর্শন পড়তে পারেন, তার সার্ভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট ধারণাটির কথাও একটু স্মরণে আনতে পারেন। কিন্তু এই নীতি ছিল শ্রমিকদের স্বার্থের বিরোধী, তাদের অবস্থার বিরোধী। শ্রমিকরা যে বাজে পরিবেশে বাস করত, বাজে পরিবেশে কাজ করত তা তাদের স্বাস্থ্য, মানসিকতা সব কিছুতেই পচন ধরায়, তাদের আয়ু অনেক কমে যায়। এটা অবশ্যই সমাজের সর্বাঙ্গীন মঙ্গলের বিরোধী। এর ফলেই ইংল্যান্ডে তখন প্রচুর শ্রমিক বিক্ষোভের সূচনা হয়।
যদিও ট্রেড ইউনিয়নগুলো প্রায়ই প্রচণ্ড রিপ্রেশনের শিকার হয়, তবুও ১৮২৪ সালের মধ্যে লণ্ডনের মত শহরগুলো জুড়ে প্রচুর ট্রেড ইউনিয়ন ছিল। এর ফলেই ওয়ার্কপ্লেস মিলিট্যান্সির বিকাশ ঘটে। টেক্সটাইল শ্রমিকরা লুডিজম আদর্শে দীক্ষিত হয়ে টেক্সটাইল মেশিনারিগুলো ধ্বংস করতে শুরু করে। সেই সাথে তখন অনেক শ্রমিক বিক্ষোভ আন্দোলন হয়ে যায়, যেমনটা দেখা যায় ১৮২০ সালে স্কটল্যান্ডে, যখন ৬০,০০০ শ্রমিক মিলে একটি জেনারেল স্ট্রাইক করে, যাকে বিধ্বস্ত করে দেয়া হয়। কিন্তু এর ফলে একই সাথে শ্রমিকদেরকে নিয়ে সিম্প্যাথিও বৃদ্ধি পায়। আর তারই প্রতিক্রিয়ায় ১৮২৪ সালে ট্রেড ইউনিয়নের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয় সরকার, যদিও ১৮২৫ সালের কম্বিনেশন অ্যাক্টে ট্রেড ইউনিয়নের এক্টিভিটিকে অনেকাংশেই বেধে দেয়া হয়। যাই হোক, একটা কথা বলতেই হয়, ১৮১০-এর দশকের মধ্যে, বিভিন্ন পেশার শ্রমিকদের একত্রিত করার জন্য প্রথম শ্রমিক সংগঠন গঠিত হয়েছিল। সম্ভবত এই ধরনের প্রথম ইউনিয়ন ছিল জেনারেল ইউনিয়ন অফ ট্রেডস, যা ফিলান্থ্রপি সোসাইটি বা জনহিতৈষী সমিতি নামেও পরিচিত ছিল, যা ১৮১৮ সালে ম্যানচেস্টারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এদের আসল উদ্দেশ্য ছিল ট্রেড ইউনিয়নের কাজই, কিন্তু তা নিষিদ্ধ হওয়ায় এই নামগুলোর আড়ালেই তারা তাদের কার্য পরিচালনা করত। যাই হোক, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পর ট্রেড ইউনিয়নের ইতিহাস আর বলছি না, এরপর ধীরে ধীরে তারা তাদের অধিকার লাভ করতে থাকে। ১৮২০ ও ৩০ এর দশকে ইংল্যান্ডে ন্যাশনাল জেনারেল ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়, ১৮৩০ এর দশকে ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রোটেকশন অফ লেবর প্রতিষ্ঠিত হয়, ১৮৩৪ সালে Grand National Consolidated Trades Union প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ট্রেড ইউনিয়নটাই প্রচুর পরিমাণে সোশ্যালিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক ও বিপ্লবীদের আকৃষ্ট করেছিল, কিন্তু টোলপাডল মার্টারের ঘটনার পর ভেঙ্গে যায়। ১৮৬০ সালে London Trades Council প্রতিষ্ঠিত হয়, আর তারপর শেফিল্ড আউটরেজের ঘটনার পর ১৮৬৮ সালে দীর্ঘমেয়াদী Trades Union Congress এর প্রতিষ্ঠা। ততদিনে লিবারাল মিডল ক্লাস ট্রেড ইউনিয়নের দাবি দাওয়াগুলোকে মেনে নিতে শুরু করেছে, যার প্রভাব পড়তে শুরু হয়েছে রাজনীতিতে। আস্তে আস্তে শুধু ইংল্যান্ড নয়, সমগ্র পাশ্চাত্য জগতেই প্রচুর ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে ওঠে ও নিজেদেরকে দাবি দাওয়া আদায় করতে থাকে। যাই হোক, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে ডিক্রিমিনালাইজ বা বৈধ করার পর একরকম যৌথ চুক্তির মাধ্যমে তাদের মজুরি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছিল। এর মানে হলো সরকার থেকে বলে দেয়া হয়েছিল যে, একটি অভিন্ন ন্যূনতম মজুরি সম্ভব না। পরিস্থিতি বুঝে একেক জায়গায় একেক রকম ন্যুনতম মজুরি বাস্তবায়ন হবে। ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত Principles of Political Economy গ্রন্থে জন স্টুয়ার্ট মিল যুক্তি দিয়েছিলেন যে, সংগঠনের শ্রমিকরা যে সমষ্টিগত কর্মের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল তার কারণে, লেইসেজ ফেয়ার নীতি আর জাস্টিফাইড নয়, বরং আইন দ্বারা তাদের মজুরি এবং শ্রমঘণ্টার নিয়ন্ত্রণ করাটাই বেশি নৈতিক। (তিনি ঠিক হুবহু এই কথা বলেননি, ভাবানুবাদ করলাম আরকি।)
সবচেয়ে কম মজুরি পেত সোয়েটশপগুলোর শ্রমিকরা। ডিটেইলে যাচ্ছিনা, এটা টেইলরিং বিজনেসের সাথে জড়িত ফ্যাক্টরি টাইপ প্রতিষ্ঠান ছিল। এখানকার ওয়ার্কিং কন্ডিশন খুব খারাপ ছিল, গাদাগাদি করে তেমন ভেন্টিলেশন ও লাইটিং ছাড়া অবস্থায় শ্রমিকরা কাজ করত, শ্রমিকরা তেমন অবসরও পেত না। সেই সাথে শ্রমিকরা ছিল খুবই আন্ডারপেইড। এই সোয়েটশপগুলো বন্ধের দাবি থেকেই প্রথম ন্যুনতম মজুরির আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের মূল ফোকাস ছিল এই সোয়েটশপগুলোর পরিমাণ যাতে আর বৃদ্ধি না পায় তা নিশ্চিত করা। এই সোয়েটশপগুলোতে বেশিরভাগই নারী ও শিশুরা কাজ করত, আর তাদেরকে খুব কম মজুরি দেয়া হতো। আর এই নারী ও শিশুদের উপস্থিতির সুযোগ তারা নেয় তাদের আনফেয়ার বারগেইনিং-এ, কারণ এরা সমাজে তখন বেশি ভালনারেবল, আর এর ফলে সোয়েটশপগুলোতে মজুরি ছিল অনেক কম। আন্দোলন হয় এই সোয়েটশপগুলো বন্ধের ও একটি ন্যুনতম মজুরি ফিক্স করে দেয়ার জন্য। আর ধীরে ধীরে আন্দোলন সফলও হয়। এই সময়েই আমেরিকায় রয়াল মিকার ও হেনরি রজারস সিগারদের মত অর্থনীতিবিদদের উদয় হয় যারা ন্যুনতম মজুরির পক্ষে যুক্তি দেন। তারা যুক্তি দিয়ে বোঝান যে, একটি ন্যুনতম মজুরি স্থাপন করলে কেবল শ্রমিকরাই লাভবান হয়না, বরং এর মাধ্যমে দরকারী সেমিস্কিলড ও স্কিল্ড লেবরদেরও ভাল হয়, আর এর মাধ্যমে অলস, ইমিগ্রেন্ট, নারী, রেশিয়াল মাইনোরিটি ও প্রতিবন্ধীদের মত “আনডিজায়ারড” শ্রমিকদের সহজে ছাটাই করা যায়। বলাই বাহুল্য, আমেরিকায় এভাবে তখন ন্যুনতম মজুরির আন্দোলনটি যুক্ত হয় সেখানে সদ্য বিকশিত ইউজেনিক্স আন্দোলনের সাথে। তবে সেটা প্রথম দিকের কথা। পরে এখান থেকে ফোকাস পরিবর্তিত হয় আর ন্যুনতম মজুরির আন্দোলন সম্পর্কিত হয় সাধারণ মানুষকে সহায়তা, তাদের মঙ্গল ও পরিবারগুলোকে অধিকতর আত্ম-নির্ভরশীল করার জন্য।
আর অর্থনীতিতে এই বিষয়টি খুব জরুরি। শ্রমিকরা কেবল উৎপাদক নয়, তারা ভোক্তাও। আর তাদের মজুরি কম হওয়া মানে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কম, আর তারা কম পণ্য কেনা মানে উৎপাদিত পণ্যের কম বিক্রয়, যার অর্থ হচ্ছে পণ্যের চাহিদা কম, মানে পণ্যের উৎপাদন কম, মানে লাভ কম। তাই অর্থনীতির অগ্রগতির জন্যই ন্যুনতম মজুরির বিধান জরুরি। কিন্তু ১৯শ শতকের ইউরোপে মজুরির অবস্থা এত খারাপ ছিল কেন? কারণ এই পণ্যগুলোর কনজিউমার কেবল ব্রিটিশরাই ছিল না, ছিল উপনিবেশী লোকজন। ভারত, চীন, দক্ষিণ চীনের জনসংখ্যার কথা ভাবুন, কনজিউমার সংখ্যার কথা ভাবুন, এই অঞ্চলগুলো থেকে কাঁচামাল নিয়ে যাওয়া হতো ইংল্যান্ডে আর সেখানে শ্রমিকদের অকথ্যভাবে খাটিয়ে এগুলো বিক্রি করা হতো এই অঞ্চলগুলোর কনজিউমারদের কাছে উচ্চমূল্যে। এভাবে ব্রিটিশরা একই সাথে উপনিবেশগুলোতে ও ব্রিটেইনের শ্রমিকদের শোষণ করে। কিন্তু এরপর কলোনিগুলোতেই প্রোডাকশন বৃদ্ধি পায়, পরে উপনিবেশই ভেঙ্গে যায়, এর ফলে উন্নত শিল্প দেশগুলোকে ভাবতে হয় তাদের দেশগুলোর কনজিউমার বা ভোক্তাদের কথা। আর তার ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করার জন্য তাদের ন্যুনতম মজুরি বৃদ্ধি করতে হয়। প্রশ্ন হলো তাহলে অনুন্নত দেশগুলোতে কেন শ্রমিকদের মজুরি এত কম থাকে? বাংলাদেশে চা শ্রমিকরা কেন দৈনিক মাত্র ১২০ টাকা মজুরি পায়? তবে কি এই অঞ্চলের মালিকপক্ষ কি অধিকতর লাভের জন্য ভোক্তাদের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন চায়না? এর উত্তর আমি দেব না, আপনারা ভাবুন…
আপনার মতামত জানানঃ