বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পদক ও পদোন্নতির বিজয়মালা এখন আর কর্মনিষ্ঠ, আত্মনিবেদিত ও দায়িত্বশীল কোনো কর্মীর ভাগ্যে নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার সেনাবাহিনীর ঘাড়ে নিজেদের পাঞ্জা এতটাই শক্ত ও নিশ্চিত করেছে যে, বাহিনীতে যে যতটা নিজেকে আওয়ামী নিবেদিত প্রমাণ করতে পারে পদক ও পদোন্নতি তার ভাগ্যেই সুপ্রসন্ন হয়। আর এজন্য বাহিনীতে গোপন এক প্রতিযোগিতা চলে। নিজেদের কাজে যতটা না মনোযোগ রাখছে তারচেয়ে বেশি রাখছে কে কতটা নিজেকে কাজে-কর্মে আওয়ামী ঘেঁষা কিংবা নিবেদিতপ্রাণ প্রমাণ করতে পারে।
এমনি কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্যের সন্ধান পাওয়া গেছে। সম্প্রতি ডিজিএফআই এর অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সূফী মোঃ আতাউর রহমানের জন্যে বিশিষ্ট সেবা পদক (Distinguished Service Medal) সুপারশি করা হয়েছে। তার গোপনীয় নথিতে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীই উল্লেখ করেছে।
যেখানে পদকের জন্য তার পক্ষে সুপারিশ বার্তায় আওয়ামী লীগের প্রতি সে কতটা নিবেদিত ছিল তার ফিরিস্তি দেওয়া হয়েছে, যা আশ্চর্য হবার মতোই। এসব সুপারিশ কিংবা প্রস্তাবনার আড়ালে দেশের নির্বাচনগুলোতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সরকারের হয়ে যে দলীয়কর্মীর মতো দায়িত্ব পালন করে থাকে সেসবও উঠে এসেছে। নির্বাচনে নিরপেক্ষ পরিবেশ সৃষ্টির চেয়ে আওয়ামী পরিবেশ সৃষ্টিতে তাদের আত্মনিয়োগ একজন বাহিনী ও দলীয়কর্মীর মাঝের পার্থক্য ঘুচিয়ে দেয়।
‘শান্তিকালীন সময়ে বিভিন্ন বীরত্বপূর্ণ কাজের( আভিযানিক/অনাভিযানিক) স্বীকৃতিস্বরূপ পদক প্রদান’ বিষয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সূফী মোহাম্মদ আতাউর রহমান পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে যে বীরত্বপূর্ণ কাজের ফিরিস্তি দিয়েছে, তার সবটাই আওয়ামী লীগের সেবায় নিবেদিত।
বাহিনীর ‘বিশিষ্ট সেবা পদক’ এর প্রস্তাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সূফী মোহাম্মদ আতাউর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। যার প্রথম হেডলাইনে লিখেছেন, ‘ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, জাতীয় সংসদ উপনির্বাচন এবং চট্টগ্রাম জেলার অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ পরিবেশে অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।’ এবিষয়ে যেসব বিস্তারিত দিয়েছেন তাতে নিরপেক্ষ পরিবেশ পাওয়া না গেলেও নির্বাচনে আওয়ামী পরিবেশ রক্ষায় তিনি কতটা নিবেদিত ছিলেন, তার হৃদয় নিংড়ানো বিবরণ রয়েছে।
গত বছর অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাজে তিনি কতটা একনিষ্ঠ ছিলেন উল্লেখ করে প্রস্তাবনায় বলেছেন, জাতীয় উন্নয়ন বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চট্টগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ের উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধমে চলমান রয়েছে। উপরন্তু বন্দর নগরী চট্টগ্রাম জাতীয় বাণিজ্য ও অর্থনীতির মূল সূতিকাগার। উন্নয়ন কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্নভাবে সচল রাখতে ও জাতীয় অর্থনীতির চাকা গতিময় রাখতে চট্টগ্রাম মহানগরের সরকারপক্ষীয় মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মহাপরিচালক ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের নির্দেশনায় এবং দূরদর্শী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সূফী মোহাম্মদ আতাউর রহমান, পিএসসি(বিএ-৪৮৯০) তার আত্মনিয়োগ ও নিরলসভাবে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত সকল মেয়র প্রার্থী ও কাউন্সিলরগণকে জয়লাভ করানোর ব্যাপারে পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।
তিনি কেবলি যে আওয়ামীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী তা নয়, স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন উপদেষ্টা ও পরামর্শদাতা হিসাবেও তার ভূমিকা রয়েছে। এবং এসব কাজে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদিও আদান-প্রদান করেছেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী এবং সকল কাউন্সিলরদের জয়লাভ করাতে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে তিনি নিজেকে আত্মানিয়োগ করে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। এছাড়াও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরোধ নিরসনেও তিনি নিজ মেধা দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন।
একইসাথে সরকারের একমুখী নির্বাচন নিয়ে যারাই সরব হয়েছেন, নির্বাচনের নামে প্রহসনের সমালোচনা করেছেন, তাদের টুটি চেপে ধরতেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন। তেমনি বার্তা রেখেছেন প্রস্তাবনায়। বলেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় নির্বাচন বিরোধী অপশক্তি সকল চক্রান্ত নস্যাৎ পূর্বক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা করতে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন।
শুধু তাই নয়, মহাপরিচালক ডিজিএফআই এর নির্দেশনায়, এই কর্মকর্তা সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রামের ৯টি পৌরসভা নির্বাচনে (সীতাকুন্ড, সন্দ্বীপ, পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, মিরসরাই, বারৈয়ারহাট, রাউজান এবং রাঙ্গুনিয়া) আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের জয়লাভে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। একইভাবে আরো ১২টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী প্রার্থীদের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশের মাধ্যমে জয়লাভে ভূমিকা রেখেছেন।
গত বছরের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের বিরোধিতা করে তখন হেফাজতে ইসলাম সারাদেশে তাণ্ডব চালায়। আর হেফাজতের মূল কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত ছিল চট্টগ্রামের হাটহাজারি এলাকা। সে এলাকায় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সূফী মোহাম্মদ আতাউর রহমান কী দক্ষতায় যে আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মীর দায়িত্ব পালন করেছেন, সে বিষয়েও প্রস্তাবনায় বিস্তারিত বলা হয়েছে। হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশের কর্মীদেরসহ, বিএনপি ও জামাত-শিবিরের কর্মীদের দমন করতেও ব্যাপকভাবে সফল হয়েছেন বলে গোপন এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ক্ষমতালোভী কোনো সরকার ক্ষমতায় থাকলে রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার এক অশ্লীল প্রতিযোগিতা দেখা যায়। এরই বলি হিসাবে আমরা দেশে বিভিন্ন সেক্টর রাজনৈতিক বানে ডুবে যেতে দেখেছি। দেশের আমলাদের মাঝেও রাজনৈতিক এই কুৎসিত খেলার বিষ ছড়িয়ে দিয়েছে দলগুলো। যার ফলে আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে থাকলেও ওসবকে রাষ্ট্রের অধীনে আর পাওয়া যায় না। সহজ কথায়, প্রতিষ্ঠানগুলোর পেশাদারিত্ব, নিজস্বতা, নিয়ন্ত্রণ ও দায়িত্ববোধ রাজনীতির অতল গভীরে তলিয়ে গেছে। এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী ও সেনাবাহিনী। আর এসবের পেছনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একনায়ক শাসনের দিকেই আঙুল তুলে আসছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা।
ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার ফাঁদে পড়ে দেশের সমস্ত বাহিনীই এখন আওয়ামী লীগের প্রশিক্ষিত বাহিনী হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগই যেন দেশ, যার সেবা করা বাহিনীর একান্ত দায়িত্ব। এমন নীতিতেই চলছে বাহিনী। তাই আওয়ামী লীগের স্তুতি যত গাওয়া যাবে, পদক ও পদোন্নতিতে যেন ততই গতি পাবে। আর এসবে আত্মনিয়োগ করতে গিয়ে কখন যে বাহিনীগুলো নিজেদের মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলেছে, রাষ্ট্রকে পঙ্গু করে দিয়েছে, স্বার্থান্ধ রাজনৈতিক দল ও বাহিনীর চোখে এসব পড়ার কথাও নয়।
সামনেই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন।আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার নানা রকমের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। কেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কব্জায় রাখার জন্য বাহিনীর মতো ইতিমধ্যে নানা জায়গায় নিজেদের প্রশাসনকে প্রস্তুত করছে। প্রশাসনে নানা রকম বদলি ও নিয়োগ দিয়ে নিজেদের লোক রাখছে। নির্বাচনের আগেই কেন্দ্র দখলে নেমেছে আওয়ামী সরকার। এমন সময়ে সেনাবাহিনী নিয়ে এমন সংবাদ আসলে যতটা ঘাবড়ে দেওয়ার কথা ছিল অতটা আর হয়নি। নির্বাচনে জেতার জন্য আওয়ামী লীগের আগ্রাসী চরিত্র কারোরই অজানা নয়। সেখানে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টা অন্যান্য সংবাদের মতোই জায়গা নিয়ে বসে পড়ে। আর আমরাও দেখতে থাকি নির্বাচনের নামে দারুণ প্রহসন।
জুলকারনাইন সায়ের (সামি), অনুসন্ধানী সাংবাদিক
আপনার মতামত জানানঃ