২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল নিয়ন্ত্রণে নেয় সশস্ত্র গোষ্ঠী তালিবান। ২০ বছর ধরে চলা যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে সে বছর ৩১ আগস্ট আফগানিস্তানের মাটি ত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশের সেনারা। শান্তি ফিরিয়ে আনতে দেশ শাসনের দায়ভার নেয় তালিবান। এই গোষ্ঠীটির দেশ শাসনের এক বছর পূর্ণ হলো সোমবার, ১৫ আগস্ট। সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটি সোমবার (১৫ আগস্ট) তাদের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের প্রথম বার্ষিকী পালন করছে।
তালিবানের অগ্রাভিযানের মুখে ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট পশ্চিমা সমর্থিত আফগান সরকারের পতন হয়। দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি সেদিনই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তার পালিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কাবুলে প্রবেশ করে গোষ্ঠীটির যোদ্ধারা।
এরপর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে তালিবান। তবে বিশ্বের কোনো দেশই এখনও অবশ্য তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। এছাড়া ক্ষমতা দখলের পর তাদের উচ্চারিত বিভিন্ন প্রতিশ্রুতিও রয়েছে অধরাই।
আফগানিস্তানের মূল সমস্যা অর্থনৈতিক সংকট। পশ্চিমারা আফগানিস্তানকে বৈশ্বিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং বৈদেশিক রিজার্ভ ফ্রিজিং করার ফলে দেশটির অর্থনীতির কাঠামো ভেঙে পড়ে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে জিডিপি এক বছরের আগের একই সময়ের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ কমে যায়। দেশের অধিকাংশ মানুষ নিঃস্ব ও ক্ষুধা মন্দার মধ্যে পড়ে। এক বছরের আগের তুলনায় সে বছর জুনে খাদ্য ও জ্বালানির দাম ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। ২০টি পরিবারের মধ্যে একটি মাত্র পরিবারে পর্যাপ্ত খাবার ছিল।
তালিবানরা শান্তি আলোচনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার ছিল, কিন্তু যা প্রত্যাহার করা হয়। তারা যে সরকার গঠন করেছে তা বিচ্ছিন্ন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়। এতে টাকা আসার বিষয়গুলি থেমে গিয়েছে। ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞাগুলি কার্যকর করা হয়েছিল তা এখন তালিবানের নেতৃত্বাধীন সরকারি সিস্টেমকে প্রভাবিত করছে। ফলে সমগ্র দেশে তার প্রভাব পড়ছে।
ক্ষুধায় ধুঁকছে আফগানিস্তান
ডয়েচেভেলের প্রতিবেদনে জানা যায়, আফগানিস্তানে দশ লাখেরও বেশি শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে এবং সে দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষই ক্ষুধার্ত। তালিবানদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার ফলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্ব কি দায় এড়াতে পারে?
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডাব্লিউএফপি) নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলে গত বছরের শেষে আফগানিস্তানের পরিস্থিতিকে ‘বিশ্বের মধ্যে নারকীয়’ বলে উল্লেখ করেন। ২০২১ সালের আগস্টে তালিবান ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে সে দেশে বোমা হামলা কিংবা গুলির ঘটনা কমেছে। তবে ব্রাসেলস-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের আশঙ্কা, তালিবান ক্ষমতায় আসার পর গত দুই দশকের যাবতীয় বোমা ও বুলেট হামলার চেয়ে আরো বেশি সংখ্যক আফগানের ক্ষুধার কষ্টে মৃত্যু হতে পারে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মতে, প্রায় ২ কোটি লোকের জরুরি খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন, যা গোটা দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক। কিন্তু সংস্থার কান্ট্রি ডিরেক্টর মেরি-এলেন ম্যাকগ্রোয়ার্টির মতে আফগানিস্তানের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ নেই। জুলাই মাসে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, কাকে কী খাবার দেয়া হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ব্যক্তির বর্তমান পুষ্টি পরিস্থিতি বা তাদের বিশেষ দুর্বলতার উপর ভিত্তি করে। ‘অত্যন্ত কঠিন এবং হৃদয়বিদারক’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ার কথা বলেন ম্যাকগ্রোয়ারটি।
ধসে গেছে স্বাস্থ্যখাত
স্বাস্থ্যখাতেও ধস নেমেছে আফগান মুলুকে। ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির (আইআরসি) জন্য কাজ করেন সামিরা সায়েদ রহমান। তিনি পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ পাকতিয়ায় একটি হাসপাতালে যাওয়ার সময় যা দেখেছিলেন তা ডিডাব্লিউকে জানান।
তার কথায়, ‘‘সেখানে পর্যাপ্ত ডাক্তার ছিল না, পর্যাপ্ত নার্স ছিল না। আমরা যে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের গত ছয় মাস ধরে বেতন দেওয়া হয়নি। ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা বেশিরভাগ নারী অপুষ্টির শিকার। নবজাতক ইউনিটে একটি ইনকিউবেটরে তিনটি শিশুকে রাখা হয়েছে।”
নারীরা নিপীড়িত
দেশটির নারীরা নিঃসন্দেহে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে রয়েছে। দুই দশক ধরে আমেরিকা- সমর্থিত সরকারের অধীনে নারীরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার সুযোগ পেয়েছিল। নারী শিক্ষার হার ২০০০ সাল থেকে ২০১৮-এর মধ্যে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। যদিও দেশটিতে নারী শিক্ষার হার মাত্র ৩০ শতাংশ। এক প্রজন্মের নারীরা চিকিৎসক, সাংবাদিক ও আইনজীবী হওয়ার সুযোগও পেয়েছেন। এখন তারা আবারো বিতাড়িত হচ্ছেন।
দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর প্রাথমিকভাবে কঠোর ইসলামি শাসনের পরিবর্তে একটি উদার শাসন কাঠামোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তালিবান।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি মেনে চলার জন্য নারীদের ওপর অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আফগানিস্তানের কয়েক হাজার মেয়েকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বাইরে রাখা হয়েছে, একইসঙ্গে নারীদেরকে অনেক সরকারি চাকরিতে ফিরে আসতে বাধা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া চলতি বছরের মে মাসে সর্বজনীন ভাবে আফগান নারীদের বোরকা পরার নির্দেশ দেওয়া হয়। কাবুলের বাসিন্দা ওগাই আমাইল বলছেন, ‘যেদিন থেকে তারা (তালেবান ক্ষমতায়) এসেছে, জীবন তার অর্থ হারিয়েছে।
তালিবান ক্ষমতায় আসার পর গত দুই দশকের যাবতীয় বোমা ও বুলেট হামলার চেয়ে আরো বেশি সংখ্যক আফগানের ক্ষুধার কষ্টে মৃত্যু হতে পারে।
আফগান এই নারীর অভিযোগ, ‘আমাদের কাছ থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, তারা এমনকি আমাদের ব্যক্তিগত জায়গায় প্রবেশ করেছে।’
এর আগে গত শনিবার রাজধানী কাবুলে কয়েক ডজন নারীর বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করে দেয় তালিবান। এ সময় নারীদের বেধড়ক লাঠিপেটার পাশাপাশি ফাঁকা গুলিও বর্ষণ করে তালিবানের যোদ্ধারা।
সংখ্যালঘু নির্যাতন
তালিবানের ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন আফগানিস্তানে বসবাসরত শিয়া মতাবলম্বী সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের শঙ্কা ছিল, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ শাসনামলের মতো যদি তারা আবার জাতিগত নিগ্রহের শিকার হয়!
আফগানিস্তানের প্রতাপশালী পশতুন জনগণ হাজারাদের কখনো তাদের সমতুল্য মনে করতে পারেনি। হাজারারা শিয়া। পশতুনরা সুন্নি। ধর্মকেন্দ্রীক এ মতভেদ এবং হাজারাদের নিজস্ব জীবন ব্যবস্থার কারণে কখনো আফগানিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে পারেনি সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আফগানিস্তানে খুবই অল্প পরিমাণ শিখ বাস করেন। তালিবান ফের ক্ষমতায় আসার সময় অনেকে দেশটি ছেড়ে চলেও গেছেন বলে সম্প্রদায়টির অনেক সদস্য ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে এসেছে যে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের হাতে বৈষম্য এবং হয়রানীর শিকার।
আফগানিস্তানের অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মতো শিখরাও লাগাতার সহিংসতার শিকার হয়েছে। ২০২০ সালে কাবুলে তাদের অন্য একটি মন্দিরে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) হামলা ২৫ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল।
ইউনাইটেড নেশনস অ্যাসিস্ট্যান্স মিশন ইন আফগানিস্তান (ইউএনএএমএ)-এর প্রকাশিত এক রিপোর্ট জানিয়েছে, গত ১০ মাসের তালিবান ক্ষমতা দখলের পর সংখ্যালঘুদের উপর সবচেয়ে বেশি হামলা চালিয়েছে পশ্চিম এশিয়ার জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর আফগান শাখা ‘ইসলামিক স্টেট খোরাসান’ (আইএসকে)। সামগ্রিকভাবে সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন, ২০১৬ জন। এর মধ্যে ৭০০ জনেরও বেশি নিহত এবং বাকিরা গুরুতর আহত হয়েছেন।
গত ১৫ অগস্ট কাবুলে তালিবানদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার পরে সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়ে হামলার ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে ওই রিপোর্টে।
রিপোর্টে আরও উঠে এসেছে জুন মাসে কাবুলের গুরুদ্বারে আইএসকে-র হামলার প্রসঙ্গ। ওই হামলায় এক শিখ ব্যক্তি-সহ দু’জন নিহত হয়েছিলেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত জঙ্গিপ্রবণ আফগানিস্তানে হাজারারা নিষ্পেষিত— এ কথা প্রমাণ দিয়ে বলা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে এমন আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে যে, আফগানিস্তানে আসলে কারা সুরক্ষিত? কেউ নয়। জোর দিয়ে বলা যায়, যত দিন ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষ হত্যা বন্ধ না হবে, ততদিন শান্তি ফিরবে না আফগান মুল্লুকে। আর ততদিন শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না হাজারারা। ফলে শান্তির জন্য আফগানিস্তানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বহু বিভক্ত আফগানিস্তানে সেই সম্প্রীতি কবে হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
নানা সংকটে আফগানিস্তান
আফগানরা নানা সংকটের সঙ্গে লড়াই করছে। কয়েক দশকের যুদ্ধের কারণে এখানে পরিস্থিতি বিধ্বস্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তিন বছর ধরে দেশের বড় অংশে খরা দেখা দিয়েছে। জুনের জুনের মাঝামাঝি বন্যা বা অমৌসুমি তুষারপাত হয়েছে কোনো কোনো জায়গায়। এ বছর দেশটিতে বড়সড় ভূমিকম্প হয়েছে। আইআরসি থেকে রহমানের মতে, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, বিদেশ থেকে অর্থপ্রদান স্থগিত করা।
২০ বছর ধরে, আফগানিস্তানের সামরিক, রাজনৈতিক এবং উন্নয়ন সহযোগিতায় ব্যাপকভাবে জড়িত ছিল পশ্চিমা বিশ্ব। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সরকারি ব্যয়ের তিন-চতুর্থাংশ বহন করেছে। রাস্তা, স্কুল এবং হাসপাতাল নির্মাণ এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণের উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় আসার পর রাতারাতি টাকা আসা বন্ধ হয়ে যায়।
২০ বছর পর গত ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান দখলে নেয় তালিবান। এরপর সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে তালিবান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার ঘোষণা দেয়।
অবশ্য সরকার গঠন করলেও বিশ্বের কোনো দেশই এখনও পর্যন্ত তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। এর জেরে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ও এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থাও আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তাসহ অর্থ সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
ফলে দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকট প্রতিদিনই খারাপের দিকে যাচ্ছে। এছাড়া তালিবানের ক্ষমতা গ্রহণের আগে থেকেই বিদেশি সহায়তার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল আফগানিস্তানের অর্থনীতি। গত বছরের আগস্ট থেকে সেই সহায়তা আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গত এক বছরে আর্থিক ও মানবিক সংকট কেবলই বেড়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০৬
আপনার মতামত জানানঃ