গতকাল রোববার জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাই কমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা আগে হলেও এখন নেই। গুম বলে আমাদের দেশে কোনো শব্দ নেই। কিছু কিছু লোক নাকি বলেছে যে, ৭৬ জন লোক গত ১০ বছরে নিখোঁজ হয়ে গেছে। তারা বলেছে, সরকার নাকি নিখোঁজ করেছে। ৭৬ জনের মধ্যে আবার ১০ জনকে দেখা যায় পাওয়া গেছে। বাকিগুলো আমরা ঠিক জানি না। পরিবার কোনো তথ্য দেয় না। পরিবারকে বলা হয়, তারা ভয়ে আর কোনো তথ্য দেয় না। আমরা জানি না তারা কোথায় গেছেন।
যদিও বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব বিষয়ের গ্রহণযোগ্য খবর রয়েছে সেগুলো হলো, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ বেআইনি হত্যাকাণ্ড; গুম; সরকারের পক্ষে নাগরিকদের নির্যাতন বা নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অপমানজনক আচরণ; কারাগারে জীবনের জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী পরিবেশ; নিবর্তনমূলক গ্রেপ্তার বা আটক; রাজনৈতিক কারণে গ্রেপ্তার; অন্য দেশে অবস্থানরত ব্যক্তির ওপর রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ; বিচারবিভাগের স্বাধীনতার জন্য বাধা; ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপর বেআইনি হস্তক্ষেপ; কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ উঠলে তার পরিবারের সদস্যদের শাস্তি দেওয়া; বাকস্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের ওপর গুরুতর বিধিনিষেধ, যার মধ্যে রয়েছে সাংবাদিকদের ওপর সহিংসতা ও হুমকি, অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার বা বিচারের মুখোমুখি করা; ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের স্বাধীনতার ওপর গুরুতর বিধিনিষেধ; শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও সমিতির স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ, যার মধ্যে রয়েছে সংগঠন, তহবিল বা বেসরকারি সংস্থা ও সুশীল সমাজ সংগঠনের ওপর বিধিনিষেধমূলক আইন। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে গুমের ঘটনা।
স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬০৩ জন গুমের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৬৯ জন ফিরে এসেছেন। আর মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে ৮১ জনকে। অধিকার র্যাবের বিরুদ্ধে ১৮৯ জনকে গুম করার অভিযোগ করেছে। এ ছাড়া পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ, আনসার পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুমের সঙ্গে জড়িত বলেও অধিকার অভিযোগ করে আসছে।
যদিও সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বরাবরই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। শাকিলের অভিযোগ বা অধিকারের প্রতিবেদন ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকেই অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করছেন কমবেশি সবাই। তবে সম্প্রতি এই গোপন কারাগার থেকে ফিরে আসা দুই ব্যক্তি প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে এক ভয়াল সত্য।
সার্ভাইভার ১
ওই রুমের ভিতরে অনেক লেখা। ওয়ালের মধ্যে খোদাই করে লেখা। আমার মনে হচ্ছে এই রুমে কতজনকে রাখা হইছে তা অনুভব করার মতো না। একেক জনের হাতের লেখা একেক রকম। ‘আমাকে ডিজিএফআই ধরে নিয়ে আসছে। ডিজিএফআই এরেস্ট করেছিল বাড়ি থেকে’ এরকম অনেক লেখা। আবার অনেকে নাম্বার লিখে রেখেছে। তার নিচে লেখা, ‘সম্ভব হলে আমার পরিবারকে বলেন যেন আমার খোঁজ করে। আমাকে এখানে সরকার বন্দি করে রেখেছে।’
সার্ভাইভার ২
উত্তরে চৌদ্দতলা বিল্ডিং, দক্ষিণে মেস বি। মাঝখানে একটা মাঠ। এর ঠিক পূর্ব পাশে লগ এরিয়া হেড কোয়ার্টার, স্টেশন হেড কোয়ার্টার ও ইনএনসির অফিস। পশ্চিম পাশে একটি এমটি শেড। ডিজিএফআইয়ের এমটি শেড। এবং উত্তর পূর্ব কোণে হলো ডিজিএফআইয়ের মসজিদ। এই ঘুম হাউজটার ছদ্মনাম হলো আয়নাঘর।
মো: সেলিম হোসেন
মূলত বাংলাদেশে ঘুম হওয়া ব্যক্তিদের কোথায় রাখা হয়, এটা অনুসন্ধান করতে গিয়েই নেত্র নিউজ খুঁজে বের করেছে এই আয়নাঘর। নেত্র নিউজের এই অনুসন্ধানের শুরু যখন মালয়েশিয়ার এক প্রবাসী তরুণ তাদের সাথে যোগাযোগ করে। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের মে মাসে কাপাসিয়া থেকে ওই তরুণকে গুম করা হয়।
প্রসঙ্গত, গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার সূর্য্যনারায়নপুর গ্রামের মৃত হোছেন আলীর ছেলে মালয়েশিয়া প্রবাসী ফেরত মো: সেলিম হোসেন (২৫) কে ওই বছর ২৯ মে সন্ধ্যায় কাপাসিয়া জামিরারচর জলসিড়ি এক্সপ্রেস পরিবহনের গ্যারেজ থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেয়। এ ব্যাপারে কাপাসিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরী (নং ৫৩৭) করেছিলেন নিখোঁজ সেলিমের বড় ভাই মুনসুর আলম। যদিও এরপর অপহরণকারীরা বুঝতে পারে যে সেলিম আসলে তাদের আসল টার্গেট নয়। তাই বেশ কয়েকমাস পর ভুয়া একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয় এবং ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর ওই মামলা থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি মালয়েশিয়ায় চলে যান।
নেত্র নিউজকে সেই প্রবাসী মো: সেলিম হোসেন বলেন, ২০১৬ সালে ২৯ মে তিনি কাপাসিয়া, গাজিপুরের একটি অটো রিপেয়ারের দোকানে অপেক্ষা করছিলেন, যেহেতু তার পরিবারের একটি বাস সেখানে ছিল।
এরপর সেখানে হঠাৎ একটা মাইক্রোবাস এসে থামে। চার পাঁচজন মানুষ সেখান থেকে নেমে আসে। যাদের একজনের হাতে অদ্ভুত দর্শন একটা যন্ত্র ছিল, অনেকটা মনিটারের মতো। ওই মুহূর্তে সেলিমের পকেটে থাকা মোবাইল ফোন ভাইব্রেট করতে শুরু করে। একটা কল এসেছিল। সে তখন পকেটে হাত দিলে, তার কাছাকাছি দাঁড়ানো লোকটা বুঝতে পারে যে তারা তাদের টার্গেট খুঁজে পেয়েছে।
তাদের মধ্যে একজন তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কি শেখ মোহাম্মদ সেলিম?’
সেলিম মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। তখন ওই লোকগুলো তার হাত ধরে মাইক্রোবাসে জোর করে তুলে নেয়। তারা সেলিমকে হাতকড়া পরিয়ে চোখ বেঁধে দেয়।
সেলিমের কোন ধারণাই ছিল না যে কারা তাকে অপহরণ করেছে বা কেনই বা তাকে অপহরণ করা হয়েছে। এরপর তাকে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর বা ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (সংক্ষেপে ডিজিএফআই) দ্বারা পরিচালিত একটি অবৈধ ও গোপন কারাগারে নেওয়া হয়।
এই প্রথমবারে মতো দুইজন সাবেক অপহৃত ব্যক্তি, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা, গোপন এই কারাগারের প্রসঙ্গে জনসম্মুখে কথা বলেছেন। এছাড়া দুইজন বর্তমান সেনা কর্মকর্তা শুধু এই কারাগারের অস্তিত্বের কথাই স্বীকার করেনি বরং এ সংক্রান্ত বেশকিছু ছবিও নেত্র নিউজকে দিয়েছেন।
হাসিনুর রহমান
বীর প্রতীক প্রাপ্ত হাসিনুর রহমান, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল, র্যাব ইউনিটের একজন সাবেক কমান্ডার, ২৮ বছরের কর্মজীবনের পর ২০১২ সালে তাকে জঙ্গিবাদের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়।
২০১৮ সালে হাসিনুর রহমানকে ডিবির এক কর্মকর্তা অপহরণ করেন। অপহরণে পর ১৮ মাস তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। এরপর তাকে যখন ছেড়ে দেওয়া হয়, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, তিনি অপহরণের বিষয়ে কিছু বলতে রাজী ছিলেন না। তবে সম্প্রতি তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছেন। এরপর নেত্র নিউজ তার সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি তার অপহরণের বিভিন্ন প্রমাণ দেবেন বলে জানান।
সেনা কর্মকর্তা হওয়ায় হাসিনুর রহমান গোপন সেই করাগারের অবস্থান সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য দিয়ে সক্ষম ছিলেন। এই তথ্য অনুযায়ী নেত্র নিউজ কারাগারের অবস্থান খুঁজে পায়। সাম্প্রতিক গুগল আর্থ স্যাটেলাইট ইমেজারি থেকে দেখা যায় যে বিল্ডিংটার ছাদ ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। রহমান সম্প্রতি ওই বিল্ডিংয়ের কাছের আর একটি বিল্ডিংয়ে যান। এবং দেখেন যে সত্যিই ওই বিল্ডিংটি ঢেকে রাখা হয়েছে।
সেলিম ও হাসিনুরের দেওয়া তথ্য পুরোপুরিভাবে মিলে যায়। এদিকে, বর্তমান এক সেনা কর্মকর্তা এটা নিশ্চিত করেছেন যে এই বিল্ডিংটার দায়িত্বে আছে ডিজিএফআইয়ের কাউন্টার টেররিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি)।
ডিজিএফআইয়ের বিরুদ্ধে রয়েছে অভিযোগ আরও অভিযোগ। সূত্র মতে, জরুরি অবস্থার মধ্যে ছাত্রদের ওপর দমন-পীড়ন, গ্রেপ্তার, নির্যাতনে ডিজিএফআইয়ের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল জানিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক বিষয়ে এই সংস্থার হস্তক্ষেপ বন্ধের সুপারিশ করেছিল সংসদীয় কমিটি। ২০০৭ সালের ছাত্র বিক্ষোভের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গত বছর সংসদে তাদের এই সংক্রান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছিলেন।
জিমনেসিয়ামে কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে সেনাসদস্যদের তর্কাতর্কির জের ধরে জরুরি অবস্থার মধ্যে ২০০৭ সালের ২০ থেকে ২৩ অগাস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তখন গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ শিক্ষকসহ অনেক ছাত্রকে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) সহ নিরাপত্তা বাহিনীর অন্যান্য সংস্থা যেমন পুলিশ, র্যাব ইত্যাদি বাহিনীর বাড়াবাড়ি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে নগ্ন হস্তক্ষেপ অনভিপ্রেত ঘটনাবলীর অন্যতম কারণ ছিল।
এসডব্লিউ/এসএস/১০৫৭
আপনার মতামত জানানঃ