শুক্রবার (৫ আগস্ট) দিনগত মধ্যরাত থেকে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এর মধ্যে প্রতি লিটার ডিজেলে বেড়েছে ৩৪ টাকা, কেরোসিনে ৩৪, অকটেনে ৪৬ ও পেট্রলে বেড়েছে ৪৪ টাকা।
দাম বাড়ার পর একজন ক্রেতাকে প্রতি লিটার ডিজেল কিনতে হচ্ছে ১১৪ টাকায়। এছাড়া প্রতি লিটার কেরোসিন ১১৪ টাকা, অকটেন ১৩৫ ও পেট্রল ১৩০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
এদিকে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় আজ (রোববার) থেকে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়িয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এর সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষেরা।
রাজধানীর মতিঝিলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হিসাবরক্ষক পদে চাকরি করেন মোস্তাক আহমেদ। বেতন পান সবমিলিয়ে ১৮ হাজার টাকা। চার সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকেন মিরপুরের কাজীপাড়ায়। বাসা ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে দিতে হয় ৮ হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়ে সংসার খরচ, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা, অফিসে যাতায়াত করেন তিনি। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান মোস্তাক।
রোববার (৭ আগস্ট) আলাপকালে মোস্তাক আহমেদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। এর ফলে গণপরিবহনের ভাড়া বেড়েছে। এছাড়া খাদ্যসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দামও বাড়বে। কিন্তু সে অনুযায়ী চাকরিজীবী বা অন্যান্য পেশার লোকজনের আয় বাড়েনি। এমন অবস্থায় অনেকের জন্যই ঢাকায় টিকে থাকা অসম্ভব হবে।
মোস্তাক আহমেদ বলেন, বেতনের একটি বড় অংশ বাড়ি ভাড়ায় চলে যায়। বাকি টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারি না। নিজের পছন্দের খাবার বা পোশাক কেনা সম্ভব হয় না। মাস শেষ হওয়ার আগেই ধার-দেনা করতে চলতে হয়। এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়?
দেশের বাজারে চলছে লাগামহীন মূল্যস্ফীতি। গত জুনের মূল্যস্ফীতি ছাড়িয়ে গেছে বিগত ৯ বছরের রেকর্ড। এ অবস্থায় নিম্নবিত্ত মানুষ নিজেদের খাদ্য চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে, মধ্যবিত্তদের ভাঙতে হচ্ছে ব্যক্তিগত সঞ্চয়।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (সানেম, সিপিডি) বলছে, এ হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি। মূল্যস্ফীতির সরাসরি প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনে, সৃষ্টি হয়েছে সংকট।
অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতির প্রভাব সম্পর্কে বলেন, মূল্যস্ফীতির প্রভাব মূলত সমাজের শ্রেণিবৈষম্যকে প্রকট রূপে আমাদের সামনে তুলে ধরে। এর প্রভাবে বাজার করতে না পেরে আধপেটা কিংবা উপোস থাকে নিম্নবিত্ত, খরচ সামলাতে মধ্যবিত্তকে সঞ্চয় ভেঙে খেতে হয়। উচ্চবিত্ত মহলে মূল্যস্ফীতির প্রভাব যতটা না আর্থিক তার থেকেও বেশি মনস্তাত্ত্বিক। মূল্যস্ফীতি উচ্চবিত্ত মহলে বিরক্তির সৃষ্টি করে।
এদিকে পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় দেশজ সঞ্চয় কমে আসছে। অর্থাৎ জিডিপি যে হারে বাড়ছে, সঞ্চয় সেভাবে বাড়ছে না। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশজ সঞ্চয় ছিল ২৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২)।
বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের অনেকেই সঞ্চয়পত্রে টাকা বিনিয়োগ করে থাকেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতির প্রভাবে এদের অবস্থা হয়েছে নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন।
জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। আর এ জন্য মূল ভুক্তভোগী হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের হিসাব থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি হয় ২ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকার। জুন মাসে মূল জমা হয় ১০ হাজার ৭১২ কোটি টাকার, আর মুনাফা পরিশোধ হয় ৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার। অর্থাৎ জুনে যারা সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই আর নতুন করে বিনিয়োগ করেননি। সে হিসাবে জুনে নিট বিক্রি দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। ছয় মাস আগের সময়কে ভিত্তি ধরলে জুনে কম বিক্রি ৮৩৬ কোটি টাকা।
তেলের দাম বাড়ায় মানুষের কষ্ট আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেন, জ্বালানির এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি প্রথমেই ধাক্কা খাবে পরিবহন সেক্টরে। আর পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে সবই সম্পৃক্ত। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। ফলে বাড়বে পণ্যের দামও। সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ এমনিতেই বাজারে যেতে পারছে না। এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এই দাম আরও অসহনীয় করে তুলবে। মধ্যবিত্তরা দিশেহারা হয়ে পড়বে। ক্রয় ক্ষমতা কমে গেলে মানুষ আর ভালো থাকতে পারে না।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় কৃষি, পরিবহন, উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানিসহ সব খাতেই প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। আর এ জন্য মূল ভুক্তভোগী হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।
রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই কার্যালয়ে শনিবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।
তিনি বলেন, একবারেই ৪২ থেকে ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি। এটা না করে আস্তে আস্তে বাড়ালে তা সহনীয় হতো। এখন তো ব্যবসায়ীদের গায়ে লাগছে। বিশেষ করে ডিজেলের দাম অনেক বেশি বাড়ানো হয়ে গেছে। আমাদের ৪২ শতাংশ ডিজেল ব্যবহৃত হয় পরিবহন ও শিল্প খাতে। সুতরাং জিনিসপত্রের দাম তো স্বাভাবিকভাবে বাড়বেই।
দাম বাড়ায় চ্যালেঞ্জ আছে কি না, জানতে চাইলে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, চ্যালেঞ্জ তো আছেই। তবে মূল চ্যালেঞ্জ তো জনগণের। ব্যবসায়ীরা তো দাম বাড়াবেন। কিন্তু জনগণকেই সেই দাম পরিশোধ করতে হবে। মূল্যবৃদ্ধিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাই আমরা সব সময় বলেছি, ধীরে ধীরে দাম সমন্বয় করতে। সেটি করলে তেমন গায়ে লাগবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১২
আপনার মতামত জানানঃ