করোনা মহামারির কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর অনেকেই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছে না। বরং কর্মহীন হওয়ায় ঐ সময়ে জীবনধারণের জন্য ঋণ নিয়েই সংসার চালিয়েছেন অনেকে। কেউবা আবার ঋণ নেওয়ার সক্ষমতাও হারিয়েছেন। এ অবস্থায় কোটি পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে খাবার দেওয়ার যে ঘোষণা এসেছে তার সঠিক বাস্তবায়ন ও প্রক্রিয়াগত দিক ঠিক করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
করোনাকালে আর্থিক সংকটের মধ্যে টিকে থাকতে ঋণ নিয়েছেন ৩৪ শতাংশ মানুষ। ঋণের টাকার এক–তৃতীয়াংশ খাদ্যপণ্য কেনাকাটায়, এক–চতুর্থাংশ আগের ঋণ পরিশোধে এবং কিছু অংশ ওষুধ কেনা ও চিকিৎসার খরচ চালানোর কাজের জন্য খরচ করা হয়েছে। ঋণ নেওয়ার উৎস হচ্ছে মহাজন, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব। ঋণের পাশাপাশি কম খেয়ে, জমা টাকা থেকে ব্যয় করে এবং কম টাকায় শ্রমে যুক্ত হয়ে টিকে থাকার লড়াই চালিয়েছেন প্রান্তিক মানুষ।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের (সিপিজে) এক জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল সোমবার(২১ মার্চ) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়।
এতে দেখা যায়, মানুষের আয় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। গত জুনে যেখানে ৬৪ শতাংশ মানুষ জানিয়েছিলেন তাদের আয় কমেছে, সেখানে ডিসেম্বরে হারটি দাঁড়ায় ৫৩ শতাংশে। তারপরও দেখা যাচ্ছে, অর্ধেকের বেশি পরিবারের আয় আগের পর্যায়ে ফেরেনি। ওদিকে নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে।
জরিপে গত ডিসেম্বরে ৪৩ শতাংশ পরিবার যেমন খাবার কেনাকাটায় খরচ কমানোর কথা জানিয়েছে, তেমনি ৩৩ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তাঁরা কম মজুরির কাজে যোগ দিয়েছেন। সঞ্চয় থেকে খরচ করেছেন ২৬ শতাংশ।
জরিপে দেখা যায়, আর্থিক সংকটের মধ্যে টিকে থাকতে গত জুনে ঋণ নিয়েছে ৬৬ শতাংশ পরিবার। ডিসেম্বরে এ হার ৩৪ শতাংশে নামে। ডিসেম্বরেও যারা ঋণ নিয়েছেন, তাদের এক–তৃতীয়াংশ সেই টাকা দিয়ে খাদ্যপণ্য কিনেছেন। এক–চতুর্থাংশ আগের ঋণ পরিশোধ এবং কিছু অংশ ওষুধ কেনা ও চিকিৎসার খরচ চালানো ইত্যাদি কাজের জন্য খরচ করা হয়েছে। ঋণ নেওয়ার উৎস হচ্ছে মহাজন, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব।
সিপিজে ‘করোনার অতিমারিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালা প্রণয়নে প্রান্তজনের কণ্ঠস্বর’ শিরোনামের জরিপটি করেছে তিনটি ধাপে। প্রথম ধাপে গত বছরের জুনে, দ্বিতীয় ধাপে সেপ্টেম্বরে এবং তৃতীয় ধাপে ডিসেম্বর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। নমুনা হিসেবে ২০টি জেলার ৪০টি উপজেলার দেড় হাজার পরিবারকে নেওয়া হয়েছিল, যা মূলত শহরের বস্তিবাসী, গ্রামের দরিদ্র, পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং নারী প্রধান ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পরিবার।
জরিপটি করতে সহায়তা করে ব্রিটিশ সরকারের ফরেন, কমনওয়েলথ ও ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও) এবং যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের কোভিড কালেক্টিভ প্ল্যাটফর্ম।
জরিপ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিজের জ্যেষ্ঠ গবেষক মৃন্ময় সমদ্দার, গবেষণা সহযোগী নাহিদা আক্তার এবং হোসাইন মোহাম্মদ ওমর খৈয়াম। কোভিড-১৯ সম্পর্কে জ্ঞান, সচেতনতা ও আচরণ, টিকার বিস্তৃতি, অভিঘাত ও নাজুক পরিস্থিতি, সংকট মোকাবিলায় কৌশল, রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ এবং সামাজিক সংহতি এ ছয় বিষয়ের ওপর জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়।
জুন, সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বর—এ তিন সময়েই সংসারের ব্যয় সামলাতে মানুষ খাদ্যের বাজেটে কাটছাঁট করেছেন। জুনে ৪২, সেপ্টেম্বরে ৫৬ ও ডিসেম্বরে ৪৩ শতাংশ পরিবার উত্তর দিয়েছে যে তারা খাবারের ব্যয় কমিয়ে সংসারের খরচ সামলানোর চেষ্টা করেছে। এরপরে ছিল সঞ্চয় ভেঙে চলা। ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় ভেঙে চলেছে। সেপ্টেম্বরে ২৬ শতাংশ পরিবার বলেছিল, তারা তাদের স্কুলগামী সন্তানকে কাজে পাঠিয়েছিল। তবে ইতিবাচক দিক হলো, ডিসেম্বরে হারটি ১ শতাংশে নেমেছে।
কোভিড-১৯–এর প্রকোপ কমার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি সহায়তা পাওয়ার হার কমেছে। গত বছরের জুনে পরিবারগুলোর ২৮ শতাংশ সরকারের অর্থ ও খাদ্যসহায়তা পেয়েছিল। জুন ও ডিসেম্বরে তা ১১ শতাংশ নেমেছে।
ঋণ নেওয়ার হার কমেছে, তার মানে এ নয় যে ওই ব্যক্তিদের আর্থিক অবস্থা ভালো হয়ে গেছে। অনেকে আগের ঋণ শোধ করতে পারেননি। তাই নতুন করে ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা হারিয়েছেন।
জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোভিড-১৯ যে একটি ভয়াবহ সংক্রামক রোগ, সে সম্পর্কে সচেতনতা আগের চেয়ে বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে টিকার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব। এরপরও ৩১ শতাংশ পরিবারের এমন সদস্য আছেন, যাঁরা প্রথম ডোজের টিকার জন্য ডিসেম্বরেও নিবন্ধন করেননি।
ঋণের বিষয়ে সিপিজের গবেষণা সহযোগী নাহিদা আক্তার বলেন, ঋণ নেওয়ার হার কমেছে, তার মানে এ নয় যে ওই ব্যক্তিদের আর্থিক অবস্থা ভালো হয়ে গেছে। অনেকে আগের ঋণ শোধ করতে পারেননি। তাই নতুন করে ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা হারিয়েছেন।
কাজের অভিজ্ঞতার তথ্য তুলে ধরে নাহিদা বলেন, রাজধানীর এক বয়স্ক বস্তিবাসী নারী তাঁকে জানিয়েছিলেন, দুই মেয়ে পোশাক কারখানায় কাজ করেন। মেয়েদের মজুরি না বাড়ায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না তারা। দুই বেলা খাবার খান। একজনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের ২০০ টাকা বাকি আছে। সেটা নিয়েও দুশ্চিন্তায় ভোগেন তিনি।
অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথির বক্তব্যে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) অন্যতম উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, সরকার এক কোটি পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে খাবার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এটা ভালো পদক্ষেপ। তবে কী প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি নিলে সরকারের সহায়তা যাদের প্রয়োজন, তাদের কাছেই সহায়তা পৌঁছাবে, সেটি ঠিক করা প্রয়োজন। কারণ, এর আগে সরাসরি মুঠোফোনে অর্থসহায়তা দেওয়ার উদ্যোগটি কাজ করেনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩২
আপনার মতামত জানানঃ