দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান ও ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের পরও থামছে না ইয়াবা পাচার। বরং নতুন নতুন কৌশল বের করছে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ইয়াবার ‘বাহক’ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে তারা। ‘নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে রোহিঙ্গা শিবিরে চলছে এ মাদকের ব্যবসা।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে ইয়াবার পাচার, মাদকসংক্রান্ত সহিংসতা, তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধ ও অবৈধ অস্ত্রের প্রাপ্যতা বেড়েছে। বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন ৭০ লাখ ইয়াবা বিক্রি হয়, যার আর্থিক মূল্য ২১০ কোটি টাকার মতো।
বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের প্রকাশিত ‘পিস রিপোর্টে’ এসব কথা বলা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ ওই প্রতিবেদনে বলেন, ২০১৭ ও ২০২০ সালে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। এ সময় ইয়াবা জব্দের পরিমাণও বাড়ে। ২০২০ সালের পর ইয়াবা উদ্ধারের পরিমাণ কমে আসে।
সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা এ ক্ষেত্রে প্রভাব রাখে। ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কত মাদক জব্দ হয়েছে তার পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তারা।
তবে ইমতিয়াজ আহমেদ লিখেছেন, এই পরিসংখ্যান কিছুটা বিভ্রান্তিকর। কারণ, এ সময়ে ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল ক্রিস্টাল মেথের উদ্ধার বাড়ে।
মাদকের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম্পর্ক নিয়ে ইমতিয়াজ আহমেদ লিখেছেন, মিয়ানমারের শান প্রদেশ থেকে মাদক ইয়াঙ্গুনে আসে। সেখান থেকে সিটওয়ে, মংডু হয়ে কক্সবাজার ও বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গায় পৌঁছায়। স্থলসীমান্ত বন্ধ হওয়ার পর অবৈধভাবে সাগরপথে মাদক পাচার হতে শুরু করে। কেউ বলতে পারেন, সাগরপথ মাদক পাচারের রুট হয়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর করেছে। কারণ, সাগর উপকূলকে সুরক্ষা দিতে হবে। শরণার্থীদের আবাসন হওয়ায় কোস্টাল গার্ড উপকূলে সুরক্ষা দিতে পারেনি।
প্রতিবেদনে সম্পাদকের বক্তব্যে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, রোহিঙ্গা ও মাদক বহনকারীদের মধ্যে একটি জটিল সম্পর্ক আছে। যারা ভালো বাংলা বলতে পারেন, তারা দক্ষিণাঞ্চলীয় উপজেলা টেকনাফ থেকে হেঁটে বা মোটরসাইকেলে করে সীমানা পেরিয়ে ইয়াবা নিয়ে আসেন। বেকারদের জন্য মাদক পরিবহন লাভজনক।
রোহিঙ্গা ও মাদক বহনকারীদের মধ্যে একটি জটিল সম্পর্ক আছে। যারা ভালো বাংলা বলতে পারেন, তারা দক্ষিণাঞ্চলীয় উপজেলা টেকনাফ থেকে হেঁটে বা মোটরসাইকেলে করে সীমানা পেরিয়ে ইয়াবা নিয়ে আসেন। বেকারদের জন্য মাদক পরিবহন লাভজনক।
সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ বাংলাদেশ ২০১২-২১ সাল পর্যন্ত মাদককে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনা পর্যালোচনা করে। এ সময় ১৩ হাজার ৯০৮টি ঘটনায় ৯৮৫ জন নিহত ও ১ হাজার ৫০৬ জন আহত হন। পিস রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ২০১৩ সালে এ ধরনের ঘটনা কম ছিল। রোহিঙ্গারা আসার পর বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটে ২০১৮-১৯ সালে। এ সময় শুধু কক্সবাজারে ২৪১ জন নিহত হন। পরিসংখ্যান বলছে, শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে মাদককারবারীরা ছোট অস্ত্র ব্যবহার করেছেন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ইয়াবাসহ ধরার পড়ার পর অনেকেই পরিচয় লুকায়। এ কারণে কী পরিমাণ রোহিঙ্গা ইয়াবা পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়ছে তার সঠিক সংখ্যা জানা কঠিন। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রোহিঙ্গারা আসার পর কক্সবাজারে ইয়াবাসহ আটকের পরিমাণ বেড়েছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের পর থেকে ইয়াবার পাচার বেড়ে গেছে। যে কারণে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ ও ২০১৮ সালে অনেক বেশি ইয়াবার চালান ও পাচারকারী ধরা পড়েছে। আবার রোহিঙ্গা শিবিরকে নিরাপদ মনে করে অনেক ইয়াবা কারবারি সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। এই সময়ে উখিয়া ও টেকনাফ থানায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মাদক মামলার সংখ্যাও শতাধিক।
এদিকে ওই প্রতিবেদনে গবেষণা সহযোগী আরেফিন মিজান লিখেছেন, মাদকবিরোধী প্রচার শুরুর পর পুলিশ ও র্যাব তাদের আভিযানিক তৎপরতা বাড়ায়। মাদককেন্দ্রিক সহিংসতা চার গুণ পর্যন্ত বাড়ে। নানা সহিংসতায়যুক্ত মাদককারবারীদের তুলনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বল প্রয়োগের ঘটনা এ সময় বেশি ছিল। ফলে প্রশ্ন ওঠে, আদৌ প্রচারের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় সংকট কমল নাকি বাড়ল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সামনে ‘রোহিঙ্গা’ বিষয় একটি বড় ধরনের জটিল চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে, যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমাধান সম্ভব নয়। কূটনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি রোহিঙ্গা নেতৃত্বের বিকাশ ঘটিয়ে বিকল্প পথের সরকারের সব আন্তরিক প্রচেষ্টা সহজে কার্যকর হচ্ছে না। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের উদার গণতান্ত্রিক এবং মানবাধিকার রক্ষাকারী চ্যাম্পিয়নদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যত দেরি করবে, খুনসহ নানা রকম সমস্যা তত বাড়বে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে মিয়ানমার সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করে এ সমস্যার সমাধান করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩২
আপনার মতামত জানানঃ