জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পৃথিবীর কোথায় নেই? পৃথিবীর প্রায় সব দেশ ছাপিয়ে পরিবেশ দূষণ আর জলবায়ু পরিবর্তন চলে গেছে পৃথিবীর দুই মেরু অ্যান্টার্কটিকা আর আর্কটিকে। পৃথিবীর উত্তরের মেরু অঞ্চল আর্কটিকের তাপমাত্রা বাড়ছে, গলছে বরফ।
চারদিকে বরফ গলে যাওয়ার নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হচ্ছে। যা দেখে চিন্তিত পরিবেশবিদরা। বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, যেভাবে গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলছে, তাতে অচিরেই নাকি ডুবে যাবে যুক্তরাষ্ট্র!
নদীর মতো বয়ে চলছে পানির স্রোত। সেই পানির স্রোতের কিছু অংশ সাদা। তার পর তা আস্তে আস্তে হয়ে যাচ্ছে নীল। ছবিটি দেখলে মনে হবে নদীর খাঁড়ি অঞ্চলের কোন প্রাকৃতিক দৃশ্য। কিন্তু আসলে তেমন কিছুই নয় এটি কোপার্নিকাস উপগ্রহের তোলা গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলার ছবি।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই সুন্দর ছবিটির মধ্যে লুকিয়ে আছে ‘ভবিষ্যতের আতঙ্ক’।
ছবিটি উত্তর গ্রিনল্যান্ডের। যেখানে প্রতিদিন অতিরিক্ত উত্তাপে গলছে টনকে টন বরফ। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, গত ১৫ থেকে ১৭ জুলাইয়ে মধ্যে তীব্র উত্তাপে গ্রিনল্যান্ডে বরফের চাদর গলতে শুরু করে ব্যাপক হারে। এর ফলে কয়েক কোটি গ্যালন মিষ্টি পানি মিশেছে সমুদ্রে।
ইউএস ন্যাশনাল স্নো অ্যান্ড আইস ডেটা সেন্টারের তথ্য অনুসারে, গ্রিনল্যান্ডে শুধুমাত্র ১৫ থেকে ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে একেক দিনে প্রায় ৬ বিলিয়ন টন পানি গলেছে। যা দিয়ে অলিম্পিক আকারের ৭২ লাখ সুইমিং পুল পানিতে পূর্ণ করা যাবে।
চলতি মাসে অ্যান্টার্কটিকা অঞ্চলে তাপমাত্রা ছিল ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা নজিরবিহীন বলেই জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, গ্রীষ্মকালেও ওই অঞ্চলের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচেই থাকে। বড়জোর তা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে পারে। কিন্তু, সেই সব হিসাবকে ছাপিয়ে গিয়েছে চলতি মাসের তাপমাত্রা। আর তার জেরেই ব্যাপক হারে বরফ গলে মিশছে সমুদ্রে।
গত ১৫ থেকে ১৭ জুলাইয়ে মধ্যে তীব্র উত্তাপে গ্রিনল্যান্ডে বরফের চাদর গলতে শুরু করে ব্যাপক হারে। এর ফলে কয়েক কোটি গ্যালন মিষ্টি পানি মিশেছে সমুদ্রে।
কেন বেড়েছে এ উত্তাপ? তার কারণ হিসেবে বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদরা আঙুল তুলেছেন বিশ্ব উষ্ণায়নের দিকে। নাসার সতর্কবার্তা, যে হারে বরফ গলছে তাতে এক দিন যদি গ্রিনল্যান্ডের সব বরফ গলে যায়, তবে পৃথিবীর মহাসাগরগুলোর জলস্তরের উচ্চতা ২৩ ফুট বেড়ে যাবে।
কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ট্রেড স্ক্যাম্বোসের মতে, গত সপ্তাহে গ্রিনল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে যে হারে বরফ গলেছে তা স্বাভাবিক নয়। গত ৩০ থেকে ৪০ বছরের জলবায়ুর গড় দেখে সে রকমই মনে হয়।
কোপার্নিকাস উপগ্রহের তোলা ছবিতে আসলে রয়েছে ‘অশনি সংকেত’— তেমনটাই মনে করছেন ট্রেড।
বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, গেল কয়েক দশকে সারাবিশ্বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অন্তত ২৫ শতাংশ বেড়েছে শুধু গ্রিনল্যান্ড আর পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুর বরফ অঞ্চল অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের হিমশৈল গলে।
আশঙ্কার বিষয় হলো, পৃথিবীর অন্য যে কোনো অঞ্চলের তুলনায় আর্কটিক অঞ্চলের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে। হিমশৈল মিশে আর্কটিক সাগরের পানির উচ্চতা বাড়াচ্ছে।
অথচ এ অঞ্চল বছরের অর্ধেক সময় বরফের অঞ্চল হয়ে থাকার কথা ছিল। বরফ গলায় অন্ধকারে থাকা বরফ বেরিয়ে আসছে, ধরে রাখছে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি।
গত বছর গ্রিনল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলের তাপমাত্রা ছিলো ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা উদ্বেগজনক। সাধারণত যে বরফ গলে, তার চেয়ে দ্বিগুণ বরফ গলছে। গ্রিনল্যান্ডে মূলত জুন থেকে সেপ্টেম্বরে বরফ গলে। কিন্তু ওই বছরে মাত্র ২ মাসে ১১ হাজার টন বরফ গলে সমুদ্রে মিশেছে।
এই অঞ্চলের আয়তন ১৭ লাখ স্কয়ার কিলোমিটার, যার প্রায় পুরোটাই শ্বেতশুভ্র বরফে ঢাকা। এ দ্বীপের মোট বাসিন্দা ৫৭ হাজার। গ্রিনল্যান্ড আর অ্যান্টার্কটিকায় পৃথিবীর বিশুদ্ধ পানির ৯৯ শতাংশ মজুদ আছে। ১৯৯৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এই দুই অঞ্চল ৭ ট্রিলিয়ন টন বরফ হারিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমরা যদি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে চাই কিংবা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রন করতে চাই, আচরণ এবং অভ্যাসগত পরিবর্তন আনার কোনো বিকল্প নেই। তবে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, আচরণ ও অভ্যাসগত পরিবর্তন প্রযুক্তি নির্ভর জ্বালানি ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত নীতিমালার পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু কখনোই তা প্রযুক্তি নির্ভর নীতিমালার বিকল্প নয়।
তারা বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও তাপমাত্রা স্বভাবিক রাখতে বৃক্ষ রোপণ বৃদ্ধিতে মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বনদস্যুদের হাত থেকে বনাঞ্চল রক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। অপরিকল্পিত বনাঞ্চল নিধনে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে পরিবেশ ও উষ্ণতা স্বভাবিক রেখে পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তুলতে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১২
আপনার মতামত জানানঃ