পাকিস্তানে বন্যা পরিস্থিতির টানা বৃষ্টিপাতে ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। ৫ সপ্তাহব্যাপী চলমান দুর্যোগে এখন পর্যন্ত ৩১২ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। খবর বার্তা সংস্থা এপির।
ভারী বৃষ্টিতে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে পাকিস্তানে। ঘরছাড়া বহু মানুষ। বিভিন্ন নদীর আটটি বাঁধ ভেঙে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা সরদার সরফরাজ বলেন, ““সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বৃষ্টি আরও দুই দিন অব্যাহত থাকবে। করাচিসহ সিন্ধুর নিম্নাঅঞ্চলজুড়ে ২৭ জুলাই পর্যন্ত মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টি হতে পারে।”
প্রবল বৃষ্টির কারণে সোমবার করাচি ও হায়দ্রাবাদে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এদিকে হায়দরাবাদের তান্ডো মোহাম্মদ খান জেলার বাকার নিজামনি গ্রামে ২০ বছর বয়সী এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। তাছাড়া দাদু ও খয়েরপুর মিরসে বৃষ্টিজনিত কারণে দুজনের মৃত্যু ও ১০ জন আহত হয়।
প্রবল বৃষ্টিতে দেখা দেওয়া হড়কা বানে বেলুচিস্তান প্রদেশে কোয়েটা-করাচি জাতীয় মহাসড়কের অন্তত দুটি সেতু ভেসে গেছে। প্রদেশটির খুজদার ও লাসবেলা এলাকায় হড়কা বানে অন্তত চার জনের মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার রাতে প্রবল হড়কা বানে সিন্ধু ও বেলুচিস্তান প্রদেশকে সংযোগকারী হাব সেতুর একটি অংশ ভেসে গেছে। এতে করাচি ও হাব শহরের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
সিন্ধু ও বেলুচিস্তানের পাশাপাশি দেশটির পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুন খোয়া প্রদেশেও ভারি বৃষ্টিতে বন্যা ও হড়কা বানের ঘটনা ঘটনায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বহু এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
দেশটির আবহাওয়া দফতর জানায়, গত বছরের তুলনায় এবার ১৫০ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হবে পাঞ্জাবে।
দক্ষিণ পাকিস্তানের বালোচিস্তানের পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছে বহু মানুষ। ডুবেছে ঘরবাড়ি। প্রবল বৃষ্টিতে বাড়ছে সেখানকার জলস্তর।
বালোচিস্তান প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর উপদেষ্টা (বিপর্যয় মোকাবিলা) বিজিউউল্লাহ ল্যাঙ্গভ জানিয়েছেন, পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৮টি বাঁধ ভেঙেছে।
বালোচিস্তানের পাশাপাশি বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের খাইবার পাখতুনখোওয়া প্রদেশের।
বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর পাশাপাশি উদ্ধারকার্যে হাত লাগিয়েছে পাকিস্তানের নৌবাহিনীও। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চলছে উদ্ধারকাজ। বালোচিস্তান থেকে দ্রুত বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে আনা হচ্ছে।
এর আগে, সোমবার টানা ২৪ ঘণ্টার বৃষ্টিপাতে শুধু করাচি শহরেই প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ১১ জন। সড়কে জলাবদ্ধতার জেরে ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল। তীব্র যানজটের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশটির এ বাণিজ্যিক রাজধানী।
ধ্বংস হয়েছে কমপক্ষে ৯ হাজার ঘরবাড়ি। অনেক এলাকায় বন্ধ হয়ে গেছে বিদ্যুৎ সংযোগ। এমন পরিস্থিতিতে চরম দুর্ভোগের শিকার বন্যাকবলিত এলাকার বাসিন্দারা। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ত্রাণ সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ করেন তারা।
সোমবার সিন্ধু প্রদেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বালুচিস্তান, খাইবার পাখতুন, পাঞ্জাব প্রদেশের পরিস্থিতি আরো অবনতির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এবারের বন্যা পরিস্থিতির সঙ্গে অনেকে ২০১০ সালের পরিস্থিতির মিল পাচ্ছে। সে বছরের বন্যায় বিধ্বস্ত হয়ে ছিলেন অন্তত ২০ মিলিয়ন মানুষ। প্রাণ হারিয়েছিলেন শতাধিক মানুষ। এবার পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতি হওয়ায় আতঙ্কিত দেশটির সাধারণ মানুষ।
সূত্র মতে, পাকিস্তানের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ খাইবার পাখতুনওয়ার কোহিস্তান জেলায় প্রবল বর্ষণে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় অন্তত ৫০টি বাড়িঘর ভেসে গেছে এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রদেশের জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র দাসু জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের।
পাকিস্তান সরকারের দুর্যোগ ব্যাবস্থাপনা বিভাগের খাইবার পাখতুনওয়া শাখার বরাত দিয়ে দেশটির জাতীয় দৈনিক ডনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের দিন রোববার থেকে প্রাদেশিক রাজধানী পেশোয়ারসহ প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে সোমবার কোহিস্তান জেলার কানদিয়া তহসিলের (উপজেলা) দু’টি গ্রামে আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। তার ফলেই ঘটেছে এই ক্ষয়ক্ষতি।
কানদিয়া তহসিলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ রিয়াজ বলেছেন, উদ্ধার তৎপরতা চালানো ও লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনতে প্রশাসনের উদ্যোগে রোববারই ৫টি উদ্ধারকারী দল গঠন করা হয়েছে এবং ইতোমধ্যে উপদ্রুত এলাকায় কাজ শুরু করেছে সেসব দল।
তবে কানদিয়ার স্থানীয় লোকজনের দাবি, তহসিলের অন্তত ৪ টি গ্রাম বন্যা উপদ্রুত এবং প্রায় ১০০ বাড়িঘর ভেসে গেছে বন্যায়। ফলে এই চারটি গ্রামে প্রায় হাজারেরও বেশি মানুষ এখন সম্পূর্ণ আশ্রয়হীন।
হাফিজ উর রেহমান নামে স্থানীয় এক মানবাধিকারকর্মী ডনকে বলেন, কানদিয়া তহসিলের দানশ, বেরতি, জাশোই ও ডাঙ্গোই— এই চার গ্রামে দেখা দিয়েছে বন্যা। বন্যা আসার আগেই এসব গ্রামের অধিকাংশ লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ায় হতাহত এড়ানো সম্ভব হয়েছে, বিপুল সংখ্যক গৃহপালিত পশুর মৃত্যু হয়েছে।
তবে কানদিয়া তহসিলের আরেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা আজিজ খান জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ইতোমধ্যে তাঁবুসহ প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের কাজ শুরু হয়েছে।
এদিকে কোহিস্তানের দাসু এলাকায় চীনের অর্থায়নে যে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, প্রবল বর্ষণ ও বন্যায় সেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কিছু ভারি যন্ত্রপাতি ভেসে গেছে বলে ডনকে নিশ্চিত করেছেন প্রকল্পের সহকারী কমিশনার হাফিজ ওয়াকার আহমেদ।
বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে উচার নালা এলাকায় সেসব যন্ত্রপাতির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কোহিস্তানের বড় এলাকা বর্তমানে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় রয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ