
দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা নজিরবিহীন আর্থিক সংকটে রয়েছে। দেশটিতে জ্বালানির জন্য কয়েক দিন ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে শ্রীলঙ্কানদের। খাদ্য ও ওষুধের সংকট চরমে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামর্থ্য নেই পণ্য আমদানিতে চাহিদা মোতাবেক ডলার সরবরাহ করার।
এমন পরিস্থিতিতে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেউলিয়া হওয়ার বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে রয়েছে পাকিস্তানসহ ১২টি দেশ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সরবরাহ করা তথ্যের ভিত্তিতে এই ১২টি দেশের তালিকা করেছে রয়টার্স। সেই তালিকাতেই রয়েছে পাকিস্তান।
ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও অন্যান্য পণ্যের। জ্বালানি তেল ও রান্না করা তেলের জন্য পাকিস্তান পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। এ ছাড়াও দেশটিতে রপ্তানির তুলনায় আমদানির পরিমাণ ব্যাপক।
ফলে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানির মূল্য পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। যেখানে জানুয়ারিতেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল ১৬.৬ বিলিয়ন ডলার, সেখানে বর্তমান রিজার্ভের পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ৯.৭ বিলিয়ন ডলারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর মাত্র ৫ সপ্তাহ আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে।
দেশটির বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এতই বেশি হয়ে গেছে যে রাজস্বের ৪০ শতাংশ ব্যয় করতে হচ্ছে বৈদেশিক ঋণের সুদ মেটাতে।
এদিকে ঋণ খেলাপি হওয়া ঠেকাতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে পাকিস্তান সরকার। এ লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রির জন্য একটি অধ্যাদেশ অনুমোদন দিয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। অধ্যাদেশে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রির ক্ষেত্রে বিদ্যমান অন্য আরও ছয়টি আইন পাস কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রির ক্ষেত্রে স্বাভাবিক যেসব প্রক্রিয়া মানার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা যাতে মানতে না হয় সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
রাষ্ট্রের সম্পদ বিক্রির জন্য পাকিস্তানের মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া অধ্যাদেশের নাম ‘ইন্টার গভর্নমেন্টাল কমার্শিয়াল ট্রানজেকশনস অর্ডিন্যান্স ২০২২’। এই অধ্যাদেশের কারণে কেন্দ্রীয় সরকার জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রাদেশিক সরকারগুলোকে নির্দেশ দিতে পারবে। সেই নির্দেশ মানতে প্রাদেশিক সরকার বাধ্য থাকবে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সরকারি সংস্থার সম্পদ ও শেয়ার বিদেশে বিক্রির বিরুদ্ধে কোনো আবেদন গ্রহণ না করতে সরকার দেশের আদালতকেও নিষেধ করেছে।
এক্সপ্রেস ট্রিবিউন আজ সোমবার জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে অনুমোদন পেলেও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি অধ্যাদেশে এখনো সই করেননি।
গত বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এ অধ্যাদেশ অনুমোদন দিয়েছে।
রাষ্ট্রীয় তেল ও গ্যাস কোম্পানি, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের শেয়ার সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে বিক্রি করে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি মার্কিন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করতে চায় সরকার। আসন্ন ঋণ খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই এই অধ্যাদেশ।
রাষ্ট্রীয় তেল ও গ্যাস কোম্পানি, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের শেয়ার সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে বিক্রি করে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি মার্কিন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করতে চায় সরকার। আসন্ন ঋণ খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই এই অধ্যাদেশ।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করেছিল পাকিস্তান। কিন্তু মে মাসে আমিরাত ঋণ দিতে আপত্তি জানায়। কারণ হিসেবে দেশটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, পাকিস্তান এখনো আগের ঋণ শোধ করতে পারেনি। ঋণের বদলে আমিরাত পাকিস্তানে দেশীয় কোম্পানির বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দেয়।
চলতি সপ্তাহে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী মিফতাহ ইসমাইল বলেন, বেসরকারিভাবে একটি লেনদেন করতে সাধারণত ৪৭১ দিন সময় লাগে।
তিনি আরও বলেন, সরকারকে জরুরিভাবে তহবিল সংগ্রহের জন্য কয়েক দিনের মধ্যে বিদেশি সরকারগুলোর সঙ্গে চুক্তি করতে হবে।
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ঋণ চেয়ে শর্তের মুখে পড়েছে পাকিস্তান সরকার। পাকিস্তানকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফের শর্ত হচ্ছে, পাকিস্তানের যে আর্থিক ঘাটতি, সেটা পূরণ করার জন্য ইসলামাবাদকে তাদের বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর কাছ থেকে ৪০০ কোটি ডলারের বন্দোবস্ত করতে হবে।
পাকিস্তানের অর্থনীতি এখন সংকটে। পাকিস্তানের মুদ্রা রুপির দামের রেকর্ড পতন হয়েছে। ১ ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপি দাঁড়িয়েছে ২২৫-এ। রুপির ইতিহাসে ডলারের বিপরীতে এটিই সর্বোচ্চ পতন।
দ্য কনভারসেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তান তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আগের চেয়ে দ্রুতগতিতে ব্যবহার করছে। এর কারণ করোনাভাইরাস মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বৈদেশিক পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে দেশটি দেউলিয়া হয়ে যাবে।
এপ্রিলেও দেশটিতে যেখানে ১ লিটার পেট্রলের দাম ছিল ১৫০ রুপি সেখানে জুলাইয়ে পেট্রলের দাম হয়েছে ২৫০ রুপি।
রান্নার জন্য ব্যবহৃত তেল মে থেকে জুনের মধ্যেই দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ।
যতদিন যাচ্ছে, দেশটিতে বাজার পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে পাকিস্তানের পরিকল্পনামন্ত্রী আহসান ইকবাল দেউলিয়া হওয়া থেকে দেশকে বাঁচাতে জনগণকে চা পান থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
এরই মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তারা গ্রাহকের থেকে যেই পরিমাণ অর্থ নেয় তার থেকেও তাদের খরচ অনেক বেশি। ৮ ঘণ্টা লোডশেডিং দিয়েও পরিস্থিতি সামলানো যাচ্ছে না। যেখানে গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং ১০ ঘণ্টারও বেশি। দেশটি চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না।
পাকিস্তানি পত্রিকা ন্যাশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটিতে বিদ্যুৎ ঘাটতি ৬ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। দৈনিক বিদ্যুৎ চাহিদা ২৮ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, যেখানে দেশটি উৎপাদন করতে পারছে মাত্র ২২ হাজার ৪৩৫ মেগাওয়াট।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন সরকার ইমরান খানের সময় জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতে যেই ভর্তুকি দেয়া হচ্ছিল তা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে দেশটিতে জ্বালানির দাম আরও ৭০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ