২০১০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেখানে বিদেশ থেকে আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরতা ছিল ১০ শতাংশের কম, ২০৩০ সালে আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বেড়ে হবে ৭০ শতাংশ। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে এটা ৯০ শতাংশও হতে পারে। সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার কথা, তার জন্য জ্বালানি (মূলত বিদেশি কয়লা, বিদেশি তেল, বিদেশি এলএনজি ও গ্যাস) খরচ বেড়ে দাঁড়াবে বর্তমান অর্থমূল্যে প্রতিবছর ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।
বর্তমান সরকারের সময়ে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। ২০০৯ সালে সরকার ক্ষমতা গ্রহণকালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল ৪,৯৪২ মেগাওয়াট। আর বিদ্যুৎসুবিধাভুক্ত মানুষ ছিল ৪৭%। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা হয়েছে ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু দুর্গম এলাকা ব্যতীত দেশের সর্বত্রই বিদ্যুতায়ন হয়ে ৯৭% মানুষ বিদ্যুৎসুবিধাভুক্ত হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাপক বৃদ্ধি পেলেও মানুষের বিদ্যুৎ প্রাপ্তি নিরবচ্ছিন্ন হয়নি। লোডশেডিং চলছে ব্যাপক! বিশেষ করে, গ্রামাঞ্চলে। রাজধানীতেও দিনে কয়েকবার করে লোডশেডিং হচ্ছে প্রতিদিনই।
বাংলাদেশ একক জ্বালানির দেশ হিসেবে দীর্ঘদিন নিজস্ব গ্যাসের ওপর ভর করে কাটিয়েছে। আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা ছিল গৌণ। কিন্তু দেশের গ্যাস মজুত ক্রমাগত কমে যাওয়া ও তা নিঃশেষ হওয়ার বাস্তবতায় সেই সুদিনের অবসান ঘটেছে। বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে বিদেশ থেকে আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে সরকারকে অনেকাংশে দায়ী করছে বিশেষজ্ঞরা।
দুর্নীতি আর বিদেশ নির্ভর জ্বালানি খাত
এবারে ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে বাজেটে ২৬ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বিদ্যুৎ খাতের এই বাজেট উপস্থাপনের সময় মুখরোচক বেশকিছু কথা বলেছেন, কিন্তু এই খাতে যে ভয়ঙ্কর দুর্নীতি লুটপাট চলছে সে বিষয়ে টু শব্দটি করেননি। আমরা জানি, বাজেটে বরাদ্দ করা অর্থের একটি বড় অংশ যাবে সাধারণ মানুষের পকেট কেটে ব্যক্তিখাতের ভর্তুকিতে। যার সাথে যুক্ত হবে বৃহৎ মাপের দুর্নীতি।
বিদ্যুৎ খাতে উন্নতির নামে শুভঙ্করের ফাঁকির বিষয়টিতে আমরা যদি দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তাহলে সেটি স্পষ্ট হবে। কুইক রেন্টালের মেয়াদ আর বাড়বে না, এর মেয়াদ নাকি ফুরিয়ে গেছে! সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, আগামী আঠারো মাসের মধ্যে তিন হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হবে। এগুলোর ৯০ শতাংশ রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্র। সরকারি পুরনো কেন্দ্রগুলোও নাকি বন্ধ করা হবে।
বেসরকারি অলস বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে জামাই আদর করতে গিয়ে গত বছর সরকারকে গুনে গুনে ৬২ হাজার কোটি টাকা অ্যানার্জি পেমেন্ট ও ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হয়েছে, এসব কেন্দ্রের ৩০ শতাংশ চালানো সম্ভব হয়নি। এতে জনগণের বিপুল পরিমাণ টাকার অযথা অপচয় হয়েছে। এদিকে, মোট উৎপাদন সক্ষমতার ৩৩ শতাংশ এবং শীতকালে চাহিদা কমে যাওয়ায় উৎপাদন সক্ষমতার শতকরা ৬০ ভাগ অব্যবহৃত থাকে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে লোকসানি মূল্যে জ্বালানি তেলও সরবরাহ করতে হচ্ছে।
মানুষের গড় বিদ্যুৎপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সূচকে দেশের অবস্থান তলানিতে! অন্যদিকে, সক্ষমতা অনুযায়ী সব বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে না পারায় ৫৮% বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা করে। তাই ভর্তুকি বেড়েই চলেছে, যা কমানোর জন্য গত ১১ বছরে বিদ্যুতের দাম পাইকারিতে ১১৬% ও গ্রাহকের ৯০% বাড়ানো হয়েছে। পুনরায় ৫৮% বাড়ানোর চেষ্টা চলেছ। নতুবা চলতি বছরে লোকসানের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা দাঁড়াবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মহাপরিকল্পনা আছে সরকারের। কিন্তু বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ মহাপরিকল্পনা নিয়ে বস্তাবায়ন হলে বিপাকে পড়বে দেশের বিদ্যুৎ খাত। কারণ এতে দেখা গেছে, ২০৪০ সাল নাগাদ শতভাগ আমদানি নির্ভর হয়ে উঠবে দেশের জ্বালানি খাত। যা দিয়েই তৈরি করতে হবে প্রায় ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। আর এটি করতে গেলে, বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার চাপ নিতে হবে অর্থনীতিকে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, চেষ্টা না করে, শতভাগ আমদানি নির্ভরতার দিকে চলে যাওয়া হবে ভবিষ্যতের জন্য বড় বিপজ্জনক। আর এ নিয়ে উন্নত দেশগুলোর উদাহরণ টানা হলেও, সে যুক্তিকে একেবারেই খোঁড়া বলছেন সরকার।
গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনা বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের জ্বালানিতে বিদেশি নির্ভরতা থাকবে প্রায় ৯২ শতাংশ। যা, ২০৪০-এ গিয়ে দাঁড়াবে শতভাগে। অথচ, সেই বছর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা ৬০ হাজার মেগাওয়াট। যার আবার ৮৪ শতাংশই আসবে প্রধান তিন জ্বালানি গ্যাস, কয়লা এবং তেল থেকে। বিদেশ থেকে জ্বালানি কিনে বিদ্যুৎ তৈরি করতে গেলে বড় চাপ পড়বে অর্থনীতিতে। কেননা, হিসাব বলছে, ২০৩০ থেকেই আমদানি বাবদ বাড়তি খরচ করতে হবে বছরে ১৬ বিলিয়ন ডলার করে। যা ২০৪০ নাগাদ ছাড়িয়ে যেতে পারে ৩০ বিলিয়ন। ফলে, এই টাকা যোগাড় করাও হবে বড় চ্যালেঞ্জের।
এদিকে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ছে সরকারি খাত। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, ২০০৯ থেকে ২০২১’র জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ১৫১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি সই করা হয়েছে। এর মধ্যে চালু হয়েছে ১১২টি। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে সরকারি ৩৮টি ও বেসরকারি ৭৩টি। আর বেসরকারি কেন্দ্রের মধ্যে রেন্টাল তথা ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র ২০টি ও আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) ৫৩টি। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের কেন্দ্র রয়েছে একটি।
উল্লেখ্য, ২০০৯ থেকে ২০২১’র জানুয়ারি পর্যন্ত উৎপাদনে আসা সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্তমান ক্ষমতা ছয় হাজার ৩৯৪ মেগাওয়াট। আর এ সময় স্থাপিত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা আট হাজার ৩৬৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্ষমতা এক হাজার ৬৫৩ মেগাওয়াট ও আইপিপিগুলোর ছয় হাজার ৭১৩ মেগাওয়াট। এছাড়া যৌথ উদ্যোগের কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট।
ভারত নির্ভরতা বিপর্যয় ডেকে আনবে
ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর, ‘৪৭ সাল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নতুন ডাইমেনশন ও গতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। কাপ্তাইয়ে পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন তার মধ্যে অন্যতম। গত কয়েক বছর ধরে ভারত থেকে বিদ্যুৎ কেনার হিড়িক শুরু হয়েছে। আমাদের বিদ্যুৎ খাত ক্রমান্বয়ে ভারতমুখী করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতবড় একটি জরুরি ও জাতীয় অর্থনীতির চালিকাশক্তি অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল করে তোলা সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। তাতে স্বনির্ভরতার গতি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকবে। বিদ্যুৎ সেক্টরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে ভিন্ন দেশের প্রভাব নিজ দেশে মারাত্মক ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে।
এই অবস্থা মোকাবিলায় এখন থেকেই আগাম কর্মকৌশল নির্ধারণ করা না হলে বিদ্যুৎখাত পুরোপুরি ভারত নির্ভর হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে ভারত থেকে। এমনটি জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। সেই সঙ্গে আরও ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনে রয়েছে।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানির জন্য ভারতের ঝাড়খন্ডে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে দেশটির বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি আদানি পাওয়ার। আদানি গ্রুপের সঙ্গে ২০১৭ সালের নভেম্বরে তাদের গোড্ডা কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বিনিময় ব্যবস্থার আওতায় ১,৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে বিপিডিবি।
বর্তমানে ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। আদানির বিদ্যুৎ গ্রিড লাইনে যুক্ত হলে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে। এতে ভারত থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুতের পরিমাণ দাঁড়াবে ২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট, যা দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ১০ শতাংশ।
ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে বাংলাদেশকে ২৫ বছরে ৭০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় করতে হবে। দেশীয় উৎপাদকদের চেয়ে আদানির বিদ্যুতের দাম বেশি, এ কারণেই বাড়তি খরচ হবে বাংলাদেশের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আদানি প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম প্রস্তাব করেছে প্রায় সাত টাকা। দেশে গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের তুলনায় এই দাম অনেক বেশি। এমনিতেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভাড়াভিত্তিক অস্থায়ী ব্যবস্থা নিয়ে সরকার দিশেহারা। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরকারকে চড়াদামে বিদ্যুৎ ক্রয় করতে হচ্ছে। আর ভাড়াভিত্তিক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করতে হচ্ছে লোকসানী মূল্যে জ্বালানি তেল ও গ্যাস।
এ অবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে না তুলে দেশের বিদ্যুৎখাতকে অতিমাত্রায় ভারত নির্ভরশীল করা হলে তা সরকারের জন্য মারাত্মক সংকট সৃষ্টি করবে। সরকার কোনভাবেই রেন্টাল আর কুইক রেন্টাল থেকে বেরুতে পারছে না। এতে করে বিদ্যুতের দাম বাড়ছেই। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগুলোও এই পরিকল্পনার গোড়ায় গলদ বলে মনে করছেন বিশেসজ্ঞরা।
সূত্র মতে, সরকার একের পর এক বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে আগ্রাহ দেখাচ্ছে। অন্যদিকে দেশে যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান করা হচ্ছে তাও বিদেশি জ্বালানী নির্ভর। এভাবে একটি দেশ বিদেশি নির্ভর নীতির সমালোচনা করেছেন খাত সংশ্লিষ্ঠরা।
তারা বলছেন, সরকার চাইলেই আরও অনেক কম মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু সরকার তা না করে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে শতভাগ বিদেশ নির্ভর হয়ে পড়ছে। এতে করে উৎপাদন ব্যয় এবং জনজীবনের ব্যয় অনেকাংশ বেড়ে যাবে। একই সাথে বড় কোন আর্ন্তজাতিক সংকট কিংবা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। উৎপাদন ব্যয় বাড়লে রপ্তানি খাতও পিছিয়ে পড়বে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২২
আপনার মতামত জানানঃ