ভিনদেশি কর্মীদের বসবাসের জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ব্যয়বহুল বাংলাদেশের রাজধানী। এই অঞ্চলের অন্যান্য বড় শহরের সাথে তুলনা করে মার্সারের জরিপে আবারো শীর্ষ স্থানে ঢাকার নামই এসেছে।
মার্কার ব্যয়বহুল নগরীর এই সূচক তৈরি করে কোন নগরীতে বিদেশিদের জীবনযাত্রার খরচের তুলনা করার জন্য। মোট দুশটি আইটেমের ব্যয় বিবেচনায় নেয়া হয়। এর মধ্যে আছে বাসস্থান, যাতায়ত, খাবার, বিনোদন থেকে শুরু করে নানা কিছুর দাম। এক কাপ কফি, এক বোতল পানি, এক লিটার পেট্রোল বা এক লিটার দুধ। মানদন্ড হিসেবে ধরা হয় নিউ ইয়র্ক নগরীকে। আর খরচের হিসেব তুলনা করা হয় মার্কিন ডলারে।
ব্যয়বহুল নগরী নির্ধারণে বিশ্বের বিভিন্ন শহরের প্রায় ২০০টি পণ্য ও সেবার মূল্য গণনা করা হয় এ জরিপে। মার্সারস কস্ট অভ লিভিং সার্ভে ২০২২- শীর্ষক এ জরিপে চিহ্নিত প্রবাসীদের জন্য বিশ্বের ব্যয়বহুলতম ১০০ নগরীর মধ্যেই রয়েছে ঢাকা। তবে আগের চেয়ে ৫৮ ধাপ নেমেছে ঢাকার অবস্থান।
চলতি বছরে ঢাকা প্রবাসী কর্মীদের জন্য বিশ্বের ৯৮তম সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর হয়েছে। ২০২১ সালে হয়েছিল ৪০তম এবং ২০২০ সালে ২৬তম। এতে ঢাকা বিদেশিদের জন্য কম ব্যয়বহুল হচ্ছে এমন ইঙ্গিত মেলে।
তবে বিশ্বের অনেক উন্নত শহরের তুলনায় এখনও ঢাকায় বসবাসের খরচ বেশি বিদেশিদের। যেমন মার্সারের তালিকায় ১৮১তম হচ্ছে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, কাতারের দোহা ১৩৩তম, সৌদি আরবের জেদ্দা ১১১ তম, কানাডার ভ্যাংকুভার ১০৮তম, থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ১০৬তম এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা ১০৪তম।
বুধবার (২৯ জুন) প্রকাশিত এ জরিপে বিশ্বের চার শতাধিক শহরের তথ্য-উপাত্ত স্থান পেয়েছে। এ বছরের র্যাংকিং তালিকায় স্থান পেয়েছে মোট ২২৭টি শহর। এসব শহরের আবাসন, পরিবহন, খাদ্য, পোশাক, গৃহস্থালি পণ্য ও বিনোদনসহ ২০০ ধরনের পণ্য ও সেবার মূল্য তুলনা করে র্যাংকিং করা হয়।
সকল তুলনার মূল ভিত্তি ধরা হয় আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরকে। আর আর্থিক মূল্য গণনা করা হয়েছে মার্কিন ডলারে। চলতি বছরের মার্চে মার্সার যে জরিপ চালিয়েছিল, সাম্প্রতিক জরিপে সেই তথ্যের অন্তর্ভুক্তি আছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় বিদেশি কর্মীদের বসবাসের ব্যয় বিবেচনায় ভারতের মুম্বাই রয়েছে ১২৭ তম স্থানে। দিল্লি ১৫৫, চেন্নাই ১৭৭ এবং বেঙ্গালুরু ১৭৮তম স্থানে।
এমনকী শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোও এদিক থেকে ঢাকার চেয়ে সস্তা, কলম্বো রয়েছে ১৮৩তম স্থানে।
দক্ষিণ এশিয়ায় বিদেশিদের থাকার জন্য আরও সস্তা হলো ভারতের হায়দেরাবাদ (১৯২তম), পুনে (২০১তম) এবং কলকাতা (২০৩তম)।
তবে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবাসীদের জন্য সবচেয়ে সস্তা শহর হিসেবে এসেছে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ ও করাচির নাম। বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে শহরদ্বয়ের অবস্থান ২২৪ ও ২২৩ তম। বৈশ্বিকভাবে চতুর্থ ও পঞ্চম সবচেয়ে কম খরচবহুল।
আন্তর্জাতিক কর্মীদের বসবাসের জন্য সবচেয়ে সস্তা নগর হলো তুরস্কের আঙ্কার, কিরগিজিস্তানের বিশকেক এবং তাজিকিস্তানের দুশানবে।
এর বিপরীতে বিদেশিদের থাকার খরচ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি হংকং শহরে, আগের জরিপেও হংকং প্রথম স্থানে ছিল। এরপর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জুরিখ এবং আরও তিনটি সুইস শহর- জেনেভা (তৃতীয়), ব্যাসেল (৪র্থ) এবং বার্ন (৫ম)।
প্রবাসী কর্মীদের জন্য ব্যয়বহুলতম ১০ শহরের চারটি এশিয়ায় অবস্থিত।
প্রবাসী কর্মীদের জন্য ব্যয়বহুলতম ১০ শহরের চারটি এশিয়ায় অবস্থিত।
এদিকে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ‘বাসযোগ্য শহরের বৈশ্বিক তালিকা ২০২২’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাসযোগ্য শহরের তালিকার শেষের ১০টি শহরের মধ্যে রয়েছে ঢাকা।
আগের বছরেও তলানিতেই ছিল ঢাকা। গত বছর বিশ্বের ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল ১৩৭তম, তালিকার নিচের দিক থেকে যা ছিল চার নম্বরে। এবার ঢাকা উঠে এসেছে সাত নম্বরে।
জীবনযাত্রার খরচ এবং ব্যবসা করার খরচের উপর নির্ভর করে বানানো এই জরিপকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকে পুরোবিশ্বের গণমাধ্যম। বিদেশীরা তাদের কাঙ্খিত শহরে কর্ম বা ভ্রমণে আসার আগে অনেকে এই ধরণের তথ্যের উপরে নির্ভর করে থাকেন। রাজধানী ঢাকার একসময়ের বড় সমস্যা ছিল বিদ্যুতের অভাব, বর্তমানে সেই সমস্যা নেই বললেই চলে।
যানবাহন-আবাসন-চিকিৎসা ও প্রযুক্তি সুবিধায়ও এগিয়েছে রাজধানীসহ দেশ। অবকাঠামোগত নানা কর্মকাণ্ডের ফলে দীর্ঘস্থায়ী জ্যাম থাকলেও চলাচলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। জলাবদ্ধতা, মশক নিয়ন্ত্রণ, গণপরিবহনের আধুনিকায়নসহ বেশকিছু সমস্যায় মনোযোগী হলে ঢাকার চিত্র যে পাল্টে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ব্যবসা করার খরচে বিভিন্ন অফিস-আদালতের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ খরচও জরিপে ব্যয়বহুল হবার অন্যতম কারণ। ১/২ দিনের কাজ কোনো কারণ ছাড়াই অনেকসময় ৭/৮দিনে গিয়ে ঠেকলে পারিপার্শ্বিক খরচও বেড়ে যায়। এছাড়া বিভিন্ন অফিশিয়াল ফি ও সার্ভিস চার্জও বাড়ানো হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। এইসব নানা কারণসহ স্বল্প ভৌগলিক অবকাঠামোর মধ্যে বহু মানুষের নাগরিক আয়োজনে খরচ-ব্যয় বাড়াটা স্বাভাবিক।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর একটি বড় পাওয়া। বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভূক্ত হয় ১৯৭৫ সালে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের অন্তর্ভূক্ত হতে ৩টি শর্ত রয়েছে। ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ৩টি শর্তই পূরণ করে। পরে ২০২১ সালেও ৩টি শর্ত পূরণে প্রয়োজনীয়তা দক্ষতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ।
বিশ্বের বিভিন্ন শহরের ওই জরিপে নানা সমস্যা-সম্ভাবনার শহর ঢাকার এই অবস্থান ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক, তা নিয়ে নানারকম ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ রয়েছে। তবে আমরা মনে করি, বাংলাদেশ মানেই বন্যা-অভাবী মুখ নয়তো কম দামের শ্রমিক, এই ধারা থেকে বের হবার সময় এসেছে। জীবনযাত্রা ও সেবার মান উন্নত করার পাশাপাশি সঠিক ভাবমূর্তি বিনির্মাণে সংশ্লিষ্টরা মনোযোগী হলে রাজধানী ঢাকার ব্যয়বহুল হয়ে ওঠা যুক্তিযুক্ত হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২০
আপনার মতামত জানানঃ