সমকামী অধিকার আন্দোলনের প্রতীক হওয়ায় রংধনু রঙের যাবতীয় পণ্যের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে সৌদি আরব। দেশটির সরকারি সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে বুধবার বার্তা সংস্থা এএফপি এ তথ্য জানিয়েছে।
পুলিশ যেসব জিনিস জব্দ করছে তার মধ্যে রয়েছে, রংধনু রঙের ধনুক, স্কার্ট, টুপি এবং পেন্সিলের কেস। এগুলোর বেশিরভাগই দৃশ্যত শিশুদের জন্য তৈরি করা।
অভিযানের সঙ্গে জড়িত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমরা এমন আইটেমগুলি যাচাই করছি যেগুলো ইসলামিক বিশ্বাস এবং জনসাধারণের নৈতিকতার সাথে সাংঘর্ষিক এবং তরুণ প্রজন্মকে লক্ষ্য করে সমকামী রঙের প্রচার করে।’
অন্যান্য বছরের মতো চলতি জুন মাসকে ‘গর্বের মাস’ (প্রাইড মান্থ) হিসেবে উদযাপন করছে উন্নত বিভিন্ন দেশের সমকামী কমিউনিটি। আর দেশ থেকে সমকামের মূলোৎপাটন করতে অভিযান চালানোর জন্য এই মাসকে বেছে নিয়েছে সৌদি।
সমকামীদের অধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রতীক রংধনু রঙের পতাকা। সমকামী সমাজের নেতাদের ভাষ্য— রংধনুতে যেমন বিভিন্ন রঙের বৈচিত্র্য থাকে, তেমনই বিশ্বের মানব সমাজও নানা জাতি-গোষ্ঠী-ভাষা ও যৌনাকাঙ্ক্ষার বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। নেতাদের দাবি, রংধনু রঙের পতাকা ওড়ানো ও এই রঙের পণ্যের ব্যবহারের মাধ্যমে মানব সমাজের নানামুখী বৈচিত্র্য স্বীকার করেন সমকামীরা।
তবে সৌদি প্রশাসন বলছে, ইসলাম ও সৌদি সংস্কৃতির সঙ্গে ‘পুরোপুরি সাংঘর্ষিক’ হওয়ায় সমকামী অধিকার আন্দোলনের কোনও প্রতীক দেশে না রাখার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। বৃহস্পতিবার দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘সমকাম ইসলাম ও আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। কিন্তু আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মকে সমকামে উৎসাহী করতে পরিকল্পিতভাবে রংধনু রঙের বিভিন্ন পণ্য দেশের বাজারে ছেড়েছে কোনও মহল।’
‘আমরা আমাদের তরুণ-তরুণী ও শিশুদের এই বিষাক্ত বার্তা থেকে মুক্ত রাখতে চাই। এ কারণেই এ অভিযান চালানো হচ্ছে।’
যেসব জিনিস জব্দ করছে তার মধ্যে রয়েছে, রংধনু রঙের ধনুক, স্কার্ট, টুপি এবং পেন্সিলের কেস। এগুলোর বেশিরভাগই দৃশ্যত শিশুদের জন্য তৈরি করা।
তবে হঠাৎ কেন এ অভিযান শুরু হলো সৌদিতে তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এএফপি জানতে পেরেছে— ঘটনার সূত্রপাত মার্কিন চলচ্চিত্র প্রস্তুত ও পরিবেশন কোম্পানি ডিজনির সর্বশেষ ফিল্ম ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ ইন দ্য মাল্টিভার্স অব ম্যাডনেস’ থেকে। চলচ্চিত্রটিতে ১২ সেকেন্ডের একটি দৃশ্য ছিল, যেখানে দুই সমলিঙ্গের চরিত্র নিজেদের পরিচয় দিয়েছিল ‘দম্পতি’ হিসেবে।
এই দৃশ্যটি চলচ্চিত্র থেকে বাদ দেওয়ার জন্য ডিজনিকে আহ্বান জানিয়েছিল সৌদি প্রশাসন। তবে তাতে সাড়া দেয়নি ডিজনি। পরে ওই চলচ্চিত্রসহ একই অভিযোগে ডিজনির আরও দু’টি চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করে সৌদি সরকার। এ দু’টি চলচ্চিত্র হল ‘লাইট ইয়ার’ ও ‘সেম-সেক্স কিস।’
সমকামীদের প্রতীক রংধনু। সমকামীতা বোঝাতে তারা এই প্রতীকটি ব্যবহার করে।
একদল সমকামী ১৯৭৮ সালের ২৫ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে সমকামীদের স্বাধীনতা রক্ষার্থে এক সমাবেশের আয়োজন করে। সেখানেই গিলবার্ট বেকার নামে এক ভদ্রলোক রংধনুকে সমকামীদের অধিকারের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করার কথা বলেন। বলাবাহুল্য, তিনি নিজেও একজন সমকামী ছিলেন।
অবশ্য বেকার প্রথমে সমকামীদের প্রতীক হিসেবে গোলাপি ত্রিভুজ রাখার চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাসে এই প্রতীকটা অন্যকিছু বোঝায়। গোলাপী ত্রিভুজ বলতে হিটলারের নাৎসী বাহিনীর হাতে ধরা পড়া কয়েদি বুঝাত। যেসব কয়েদিদের নানাভাবে যৌন নির্যাতন করা হতো। তাই তিনি রংধনুকে বেছে বেছে নেন। বেকারের ভাষায়— আমি আসলে প্রতীক হিসেবে এমন কিছু চাইছিলাম যা প্রকৃতির মাঝেই আছে। কেননা যে যাই বলুক সমকামিতা তো প্রকৃতিরই অংশ’।
অবশ্য প্রতীক হিসেবে এই রংধনুতে রঙ একটু ভিন্ন- গোলাপি, বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল। এর বেগুনি রঙের মানে হলো আত্মা, নীলের মানে শিল্প বা মানসিক প্রশান্তি, আসমানি মানে ম্যাজিক বা জাদু, সবুজ মানে প্রকৃতি, হলুদের মানে সূর্য, কমলার অর্থ সুস্বাস্থ্য, লাল মানে জীবন এবং গোলাপি মানে যৌনতা। অনেক সময় আবার গোলাপী ব্যবহৃত হয় না। কেননা বেকার মনে করেন সমকামীতা মানে শুধুই যৌনতা নয়।
সমকামীদের প্রতীক তৈরি করা নিয়ে বেকার বলেন— ‘আমার কাছে এই রংধনু প্রতীক তৈরি করাটা ছিল রীতিমত চ্যালেঞ্জের মতো। একে তো সমকামীদের নিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সমাবেশ, তার উপরে এই প্রতীকের ব্যাপার-স্যাপার। আমি চাইছিলাম এমন কিছু তৈরি করতে যা সমাজকে মনে করিয়ে দেয় সমকামীরাও মানুষ। ওই সময়টাতে সেটার খুবই দরকার ছিল।’
সমকারীদের কাছে বেকারের প্রতীকটি গ্রহণযোগ্যতা পায় ও সান ফ্রান্সিস্কোর সেই সমাবেশে এই রংধনু পতাকাটি সর্বপ্রথম উত্তোলিত হয়। ২০১৫ সালে এই রংধনু পতাকাটি নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে সংরক্ষিত হয়।
সমকামীদের প্রতীক এ পতাকার আরেকটি নাম হলো LGBT Pride Flag, যেখানে L মানে লেসবিয়ান, G মানে গে, B মানে বাইসেক্সুয়াল এবং T মানে ট্রান্সজেন্ডার। তার মানে এই পতাকা নিছকই সমকামীদের অধিকার নিয়েই কথা বলে না, কথা বলে এলজিবিটি গোত্রের সবার জন্যই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪৪
আপনার মতামত জানানঃ