জার্মানিতে ক্যাথলিক চার্চের যাজকদের দ্বারা হাজারো শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে৷ গত কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন নথিপত্রের ভিত্তিতে তৈরি গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য৷
গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলের ক্যাথলিক গির্জায় কমপক্ষে ৬১০ জন অপ্রাপ্ত বয়স্কের যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার তথ্য৷ধর্মযাজকদের যৌন লালসার শিকার প্রাপ্ত বয়স্কদেরও বিবেচনায় নিলে সংখ্যাটা ছয় হাজার ছাড়াবে৷
গতকাল সোমবার জার্মানির মানস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৮ সালে করা আগের গবেষণার চেয়ে এ সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ বেশি।
সোমবার প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ম্যুনস্টারের বিশপের এলাকায় আগে যেমনটি আশঙ্কা করা হয়েছিল যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়নের ব্যাপকতা তার চেয়ে অনেক বেশি৷ গবেষণাটি করেছেন মিউনিখ বিশ্ববিদল্যালয়ের গবেষকরা৷ ১৯৪৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ মোট ৭৫ বছরের তথ্য সংগ্রহ এবং যাচাই করতে মোট দুই বছর সময় নিয়েছেন গবেষকরা৷
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, মানস্টার অঞ্চলে ৬১০ জনের যৌন হয়রানির ঘটনা আনুষ্ঠানিকভাবে নথিভুক্ত রয়েছে। তবে এ অঞ্চলে আসলে ১৯৬ ধর্মযাজকের হাতে পৃথকভাবে অন্তত ৫ হাজার ৭০০টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। ৫ শতাংশ ধর্মযাজকের বিরুদ্ধে একাধিক যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। তাদের হাতে ১০ জনের বেশি শিশু নিপীড়নের শিকার হয়। তবে অভিযুক্ত ধর্মযাজকদের মধ্যে ১০ শতাংশের কম আইনের মুখোমুখি হয়েছেন।
জার্মানির ওই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি যৌন নিপীড়ন হয়েছে গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে। ওই সময়ে মানস্টার অঞ্চলে প্রতি সপ্তাহে গড়ে দুটি করে এমন ঘটনা ঘটেছে। হয়রানির শিকার চারজনের মধ্যে তিনজনই বালক। তাদের বেশির ভাগের বয়স ১০ থেকে ১৪ বছর।
এই বালকেরা পরে মানসিক নানা সমস্যায় ভুগেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। অনেকের মধ্যে বিষণ্নতা দেখা দিয়েছে। এমনকি আত্মহত্যার ভাবনাও এসেছে অনেকের মাথায়। যৌন হয়রানির কারণে ২৭ জন আত্মহত্যারও চেষ্টা করেন বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
মানস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদনে অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছে ফেলিক্স জেনের দিকে। তিনি ২০০৯ সাল থেকে মানস্টার অঞ্চলের বিশপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বলা হচ্ছে, যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর ফেলিক্স জেন বলেন, যৌন হয়রানি সামাল দিতে তিনি যেসব ভুল করেছেন, সেগুলোর দায় নেবেন। এ নিয়ে আগামী শুক্রবার বিস্তারিত কথা বলবেন বলে জানান তিনি।
মানস্টার অঞ্চলে প্রতি সপ্তাহে গড়ে দুটি করে এমন ঘটনা ঘটেছে। হয়রানির শিকার চারজনের মধ্যে তিনজনই বালক। তাদের বেশির ভাগের বয়স ১০ থেকে ১৪ বছর।
জার্মানিতে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের গির্জায় যৌন নিপীড়নের ঘটনার তথ্য চলতি বছর প্রথম খবরে আসে জানুয়ারি মাসে৷ তখন জানা গিয়েছিল মিউনিখ এলাকার গির্জাগুলোতে অতীতে বহু যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে এবং গির্জা কর্তৃপক্ষ সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তি না দিয়ে বরং সত্য চাপা দেয়ার চেষ্টা করেছে৷
সাবেক পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টের বিরুদ্ধেও রয়েছে দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ৷১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত মিউনিখ এবং ফ্রাইজিং অঞ্চলে আর্চবিশপের দায়িত্ব পালন করা পোপ বেনেডিক্ট অবশ্য সে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন৷
এর আগে ২০১৮ সালে জার্মান বিশপ কনফারেন্সে যৌন হয়রানি-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৪৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জার্মানিতে ৩ হাজার ৬৭৭ জন অপ্রাপ্তবয়স্ককে কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। এতে জড়িত ১ হাজার ৬৭০ জন ধর্মযাজক।
মিউনিখ ও ফ্রেইসিং অঞ্চলেও ধর্মযাজকদের হাতে শিশুদের যৌন নিপীড়নের তথ্য উঠে আসে অন্য একটি প্রতিবেদনে। গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট যখন মিউনিখের বিশপ ছিলেন, তখন গির্জায় শিশুদের যৌন নিপীড়ন ঠেকাতে ব্যর্থ হন।
২০১৯ সালে ক্যাথলিক গির্জায় যৌন নিপীড়ন বিষয়ক সম্মেলনে গির্জায় শিশুদের যৌন নিপীড়নের বিষয়ে কঠোর হতে বলেছিলেন পোপ ফ্রান্সিস৷
পোপ বলেছিলেন, গির্জায় যৌন নিপীড়নের প্রতিটি ঘটনার বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ যৌন নিপীড়নের সাথে জড়িত থাকা পাদ্রীদের ‘শয়তান’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন সমাজেই শিশুদের যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটতো৷ শিশুদেরকে ‘হিংস্র হায়েনার’ হাত থেকে রক্ষা করতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, যৌন নিপীড়নকারী এই ‘শয়তানদের মোকাবেলা করা হবে’৷ ‘শিশুদের যৌন নীপিড়নের হাত থেকে বাঁচাতে আমি সবাইকে কাজ করার জন্য আন্তরিক আহ্বান জানাই,’ বলেন পোপ৷
সারা বিশ্ব থেকে ১৯০ জন গির্জা প্রধান, ১১৪ জন বিশপ, ১০ জন নারী প্রতিনিধি এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছেলেন৷ ক্যাথলিক গির্জায় পাদ্রীদের দ্বারা শিশুদের যৌন নিপীড়নের এ ঘটনা অস্ট্রেলিয়া, অ্যামেরিকা, চিলি, জার্মানিসহ সারা বিশ্বে আলোচিত ঘটনা৷
যদি ও সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী যৌন নিপীড়নের শিকার ব্যক্তিরা যৌন নির্যাতন ঠেকাতে পোপ কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেননি বলে নিন্দা জানান৷ জ্য-মারি ফুরব্রিংগার নামে নিপীড়নের শিকার সুইজারল্যান্ডের এক ব্যক্তি বলেছিলেন ,পোপ তার বক্তৃতায় শয়তানদের বিষয়ে বলেছেন৷ পোপের বক্তৃতাকে ‘বকবকানি’ বলে মন্তব্য করেন তিনি৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৯
আপনার মতামত জানানঃ