শ্রীলঙ্কায় একটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তি নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। দেশটির একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা এর আগে অভিযোগ তোলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওই প্রকল্প ভারতীয় ব্যবসায়ী গৌতম আদানির শিল্পগোষ্ঠীকে দিতে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেকে চাপ দিচ্ছেন।
তবে এখন ওই কর্মকর্তা আগের অবস্থান থেকে সরে এসে বলছেন, ‘আবেগে কাবু হয়ে’ তিনি এসব কথা বলেছিলেন। আজ সোমবার ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। তবে শ্রীলঙ্কার বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের প্রধানের এমন অভিযোগ নিয়ে ভারত সরকার এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।
আর এই অভিযোগ পালে হাওয়া দিয়েছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে, যেখানে দেখানো হয় এক ইউনিট বিদ্যুৎ না নিয়েও শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার চার মাসে আদানি গ্রুপকে ১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা কেন্দ্রভাড়া দিতে রাজি হয়েছে। উপরন্তু আদানি গ্রুপের বিদ্যুতের প্রয়োজনই নেই দেশে। তবুও কেন লোকসান করে এই চুক্তি? কোন স্বার্থে? তাহলে ভারত বান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার কি নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় দেশের টাকা অযথা অপচয় করছে?
যে কারণে বিতর্ক শ্রীলঙ্কায়
বিতর্ক তৈরি হয়েছে ৫০০ মেগাওয়াটের একটি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পকে ঘিরে। প্রকল্পটি হচ্ছে শ্রীলঙ্কার মান্নার জেলায়। গত শুক্রবার শ্রীলঙ্কার সিলন ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের (সিইবি) চেয়ারম্যান এম এম সি ফার্নান্দো দেশটির পার্লামেন্টের একটি প্যানেলকে বলেন, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে তাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পটির কাজ গৌতম আদানির শিল্পগোষ্ঠী আদানি গ্রুপকে দেওয়ার জন্য তাঁকে সরাসরি চাপ দিচ্ছেন।
শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের কমিটি অন পাবলিক এন্টারপ্রাইজের (সিওপিই) উন্মুক্ত শুনানিতে ফার্নান্দো এ অভিযোগ তোলেন। শুনানির একটি ভিডিও ফুটেজ টুইটারে প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফার্নান্দো পার্লামেন্টের সিওপিইর শুনানিতে বলেন, ‘রাজাপক্ষে আমাকে বলেছেন, মোদির কাছ থেকে চাপে আছেন তিনি।’
এক দিন পর প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে নিজে টুইটারে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন। এরপর গতকাল রোববার ফার্নান্দো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে অন্য কথা বলেন। তিনি এবার দাবি করেন, তাকে এমন কিছু প্রশ্ন করা হচ্ছিল যেগুলো তাকে দোষী প্রমাণিত করে। এতে ‘আবেগে কাবু হয়ে’ তিনি প্রকল্পটি নিয়ে মোদির চাপের কথা এভাবে বলেছেন।
প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে টুইট করেন, ‘মান্নারে একটি বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প দেওয়া নিয়ে সিওপিই কমিটির শুনানিতে সিইবির চেয়ারম্যানের দেওয়া একটি বিবৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলছি, কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এই প্রকল্প দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করছি। আমি বিশ্বাস করি, এই বিষয়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যোগাযোগ করবেন।’
প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকেও এ নিয়ে একটি লম্বা বিবৃতি দেওয়া হয়। তাতে ওই প্রকল্প ঘিরে যেকোনো ব্যক্তির প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়।
তাতে আরও বলা হয়, প্রেসিডেন্ট স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, তিনি মান্নারের ওই বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পটি কোনো ব্যক্তি বা সংস্থাকে দেওয়ার বিষয়ে অনুমোদন দেননি।’
এক দিন পর ফার্নান্দোকে উদ্ধৃত করে শ্রীলঙ্কার দৈনিক দ্য মর্নিংয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়ে, ফার্নান্দো এ ব্যাপারে ক্ষমা চেয়েছেন এবং তিনি বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত চাপ আর আবেগের বশবর্তী হয়ে তিনি এমন কাজ করেছিলেন।
এর এক দিন পর শ্রীলঙ্কা সরকার আইন পরিবর্তন করে বিদ্যুৎ প্রকল্পটির কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের বাধ্যবাধকতা তুলে নিলে বিতর্ক নতুন মাত্রা পায়। বিরোধী দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে ভারতের আদানি গ্রুপকে ওই বিদ্যুৎ প্রকল্পটি দেওয়ার জন্য সরকার আইন পরিবর্তন করেছে।
এনডিটিভির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত বছরের অক্টোবরে শ্রীলঙ্কা সফরে যান আদানি গ্রুপের কর্ণধার গৌতম আদানি। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে তিনি টুইটও করেন। বন্দর প্রকল্প ছাড়াও অংশীদারত্বের ভিত্তিতে শ্রীলঙ্কার অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর দিকে মুখিয়ে আছেন বলেও জানান তিনি।
যে কারণে প্রশ্ন উঠছে বাংলাদেশের চুক্তি নিয়ে
শ্রীলঙ্কার অভিযোগের প্রেক্ষিতে, প্রশ্ন রাখা যায় যে নরেন্দ্র মোদি কি শেখ হাসিনাকেও চাপ দিয়ে আদানির সাথে অপ্রয়োজনীয় চুক্তি করিয়েছে। কারণ প্রয়োজন না হলেও ভারতের ঝাড়খন্ডে আদানি গ্রুপের দুটি ইউনিটে ১৫০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আগামী ২৫ বছর মেয়াদে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্রভাড়া হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ১ লাখ ৮ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা বা ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ নেবে। এ দিয়ে কমপক্ষে তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।
প্রসঙ্গত, ভারতের পাঁচটি উৎস থেকে বর্তমানে বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ। যদিও চাহিদা না থাকায় আমদানি সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে না। এরপরও ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে আমদানি করা হবে আরও এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদানির এ বিদ্যুৎ আমদানির কোনো প্রয়োজনই ছিল না। কারণ বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। আর চাহিদা ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। তবে শীতে এ চাহিদা সাত থেকে আট হাজার মেগাওয়াটে নেমে আসে। আবার সন্ধ্যার তুলনায় দিনে চাহিদা অনেকখানি কমে যায়।
তাই উচ্চ ব্যয়ে আদানির বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত পুরোই অযৌক্তিক। এছাড়া এ বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয়ও অনেক বেশি পড়বে বলে আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে এসেছে।
এদিকে, বিডব্লিউজিইডি ও গ্রোথওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আগামী আগস্ট মাসে উৎপাদন শুরু করবে, যদিও সঞ্চালন লাইন নির্মিত না হওয়ায় বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ সম্পন্ন হলেও আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে এক ইউনিট বিদ্যুৎ না নিয়েই আদানি গ্রুপকে ১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা কেন্দ্রভাড়া দিতে হবে।
বিডব্লিউজিইডি ও গ্রোথওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানি গ্রুপ প্রতি বছর কমপক্ষে ৩ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা বা ৪২৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি কেন্দ্রভাড়া নেবে। এই বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জনগণের উপকার না করে বরং আদানি গ্রুপকে আরও ধনী হওয়ার সুযোগ করে দেবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আদানি পাওয়ারের এ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানিকৃত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম হবে কমপক্ষে ৯ টাকা ৯ পয়সা; যা বিদ্যমান আমদানিকৃত বিদ্যুতের মূল্যের তুলনায় ৫৬ শতাংশ ও ভারতের সৌরবিদ্যুতের তুলনায় ১৯৬ শতাংশ বেশি।
এ ছাড়া, আদানি গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুতের দাম প্রতি বছর কমপক্ষে ৫.৫ শতাংশ হারে বাড়বে। অন্যদিকে দেশে ও প্রতিবেশী দেশ ভারতে উৎপাদিত সৌরবিদ্যুতের দাম প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে।
বিডব্লিউজিইডির সদস্য সচিব হাসান মেহেদী বলেন, ‘এ বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক চাপ তৈরি করবে। বাংলাদেশের অতি-সক্ষমতার মাত্রা ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার পর ভারত থেকে অতি-খরুচে বিদ্যুৎ আমদানির কোনো যৌক্তিকতা নেই।’
৭৪৮ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিটে মোট ১৪৯৬ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ঝাড়খন্ডের গড্ডা জেলায়। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আনতে ২৪৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে হবে। এর ৯৫ কিলোমিটার ভারতের অংশে, বাকিটা বাংলাদেশে। ভারতের অংশে যে লাইন নির্মিত হবে, তার ব্যয়ও বিদ্যুতের দামের মধ্যে ধরা হয়েছে।
তাই এই প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয় যে, শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশকেও চাপ দিয়েই কি এই অসম চুক্তি করিয়েছে নরেন্দ্র মোদি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ