ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ওপর ‘পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ’ কায়েমের চেষ্টা করছে। ফিলিস্তিনে দখলদারত্ব অবসানের কোনো ইচ্ছাই নেই ইসরায়েলের।
২০২১ সালে গঠিত জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের একটি তদন্ত কমিটির এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
গত মঙ্গলবার(০৭ জুন) ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরার এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত ১৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কেবল দখলদারি অবসানই যথেষ্ট হবে না।’ এতে ফিলিস্তিনিদেরও সমান মানবাধিকার নিশ্চিতে আরও পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
প্রতিবেদনে প্রমাণ উল্লেখ করে বলা হয়, ‘দখলদারি অবসানের কোনো ইচ্ছা ইসরায়েলের নেই।’ পূর্ব জেরুজালেমসহ দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ‘পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের’ পথে হাঁটছে ইসরায়েল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দেশটি এই এলাকা দখল করে নেয়। পরে ইসরায়েলের সঙ্গে তা যুক্ত করা হয়, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনো স্বীকৃতি দেয়নি।
কমিশন বলেছে, ‘জনমিতির গঠন বদলে দিতে ফিলিস্তিনিদের জন্য নিপীড়নমূলক পরিবেশ আর ইসরায়েলি সেটলারদের জন্য অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখার কাজ করে আসছে ইসরায়েলি সরকার।’
উদাহরণ হিসেবে ইসরায়েলি নাগরিকদের সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ ফিলিস্তিনিদের স্বাভাবিক নাগরিক অধিকার অস্বীকার করে প্রণীত একটি ইসরায়েলি আইনের কথা উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। এতে ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি (আরব) নাগরিকদের জন্য ‘পৃথক নাগরিক মর্যাদা, অধিকার ও আইনি সুরক্ষা’ প্রদানের অভিযোগ করা হয় দেশটির বিরুদ্ধে।
দখলকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমের বসতিগুলোতে সাত লাখের বেশি ইসরায়েলি সেটলার বর্তমানে বসবাস করছেন। ওই এলাকায় ৩০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনির বসবাস। এখানকার ইসরায়েলি বসতিগুলো সুরক্ষিত। শুধু ইহুদিদের বসবাসের জন্য নির্মিত এসব হাউজিং কমপ্লেক্স আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ।
ইসরায়েল কর্তৃক অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা বিষয়ে গঠিত জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলকে কেবল গাজার অবরোধ তুলে নিলেই হবে না। সেখানে এমন অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে যাতে ফিলিস্তিনের নেতারা তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র নির্মাণের বিষয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নেওয়া ইসরায়েলি নীতিকে জাতি-বিদ্বেষের সঙ্গে তুলনা করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো নেতৃস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
জনমিতির গঠন বদলে দিতে ফিলিস্তিনিদের জন্য নিপীড়নমূলক পরিবেশ আর ইসরায়েলি সেটলারদের জন্য অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখার কাজ করে আসছে ইসরায়েলি সরকার।’
অবরুদ্ধ গাজায় ২০২১ সালের মে মাসে ইসরায়েলি আগ্রাসনের পর এই কমিশন গঠন করা হয়। ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ২৬০ ফিলিস্তিন নিহত হন। ইসরায়েলে নিহত হন ১৩ জন। কমিশনকে এই আগ্রাসনের আগে ও পরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত করতে বলা হয়।
প্রকাশিত প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়েছে হামাস ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। দায়মুক্তির অবসানে ইসরায়েলকে জবাবদিহির আওতায় আনারও আহ্বান জানিয়েছে তারা। অন্যদিকে, প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরায়েল। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এটা ‘অর্থ ও পরিশ্রমের অপচয়’ যা শুধু অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর নামান্তর।
যে ভূখণ্ডকে ইসরায়েল নামে ডাকা হয়, তা আসলে ইসরায়েলের ভূখণ্ড নয়, এটি ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। সে হিসেবে আন্তর্জাতিক ভূমিদস্যু ইসরায়েল অবৈধ দখলদার।
১০ হাজার ৪২৯ বর্গমাইল আয়তনের ফিলিস্তিন ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানরা পরাজিত হলে ফিলিস্তিন ব্রিটিশদের অধিকারভুক্ত হয়। ১৯২২ সালে জাতিসংঘ তার গঠনতন্ত্রের ২২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ফিলিস্তিন প্রশাসন পরিচালনার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে সাময়িকভাবে কর্তৃত্ব বা ম্যান্ডেট প্রদান করে।
উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনের প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবকাঠামো গড়ে ওঠার পর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় সত্তা গঠন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজিত রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে অধিকৃত কিছু ঔপনিবেশিক অঞ্চলের সাময়িক শাসনের দায়িত্বও জাতিসংঘের কোনো কোনো সদস্য রাষ্ট্রের ওপর অর্পণ করা হয়। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয়ের আগে অন্তর্বর্তীকাল এসব অঞ্চলের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত কোনো রাষ্ট্রের অভিভাবকত্বের অধীনে প্রদান করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজিত তুরস্ক, জার্মানি, ইতালি ও জাপানের কাছ থেকে অধিকৃত যেসব অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের অভিভাবকত্বের অধীনে প্রদান করা হয়েছিল, একে একে সবাই স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণতি লাভ করেছে। কিন্তু ব্যতিক্রম দেখা দেয় ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে।
ফিলিস্তিনের ব্রিটিশ রক্ষক ভক্ষকে পরিণত হয়। ফিলিস্তিনের জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটেন ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। ব্রিটিশ সরকার ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিলেও ফিলিস্তিনে রাষ্ট্র গঠনের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক ইহুদি ছিল না। অল্প কয়েক হাজার ইহুদির বাস ছিল তৎকালীন ফিলিস্তিনে। ব্রিটিশ সরকার ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে তাই নানা প্রান্ত থেকে ইহুদিদের নিয়ে এসে ফিলিস্তিনে জড়ো করতে থাকে। ইহুদিদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি মুসলমানদের ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত করতে ব্রিটিশ সরকার ইহুদি সন্ত্রাসীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করে।
অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ পেয়ে ইহুদিরা বেশ কয়েকটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে তোলে। এদের মধ্যে ভয়ংকর সন্ত্রাসী সংগঠন ছিল হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং; যারা হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের বাধ্য করে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে৷ আর এই সুযোগে ফিলিস্তিনিদের জমিজমা ইহুদিরা দখল করে নেয়।
ব্রিটিশরা এই সমস্যার কোন সমাধান করতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ছাড়ে। ইহুদী নেতারা এরপর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়।
বহু ফিলিস্তিনি এর প্রতিবাদ জানান এবং এরপর যুদ্ধ শুরু হয়। প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সৈন্যরাও যেখানে যায় যুদ্ধ করতে।
হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে তখন হয় তাদের ঘরবাড়ি ফেলে পালাতে হয় অথবা চলে যেতে বাধ্য করা হয়। ফিলিস্তিনিরা এই ঘটনাকে ‘আল নাকবা’ বা ‘মহা-বিপর্যয়’ বলে থাকে।
পরে এক যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে যখন যুদ্ধ শেষ হলো, ততদিনে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের বেশিরভাগ অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। জর্ডান দখল করেছিল একটি অঞ্চল, যেটি এখন পশ্চিম তীর বলে পরিচিত। আর মিশর দখল করেছিল গাজা।
জেরুজালেম নগরী ভাগ হয়ে যায়, ইসরায়েলি বাহিনী দখল করে নগরীর পশ্চিম অংশ, আর জর্ডানের বাহিনী পূর্ব অংশ।
দু’পক্ষের মধ্যে যেহেতু কখনোই কোন শান্তি চুক্তি হয়নি, তাই উভয় পক্ষই অপর পক্ষকে দোষারোপ করতে থাকে। দুই পক্ষের মধ্যে পরের দশকগুলোতে এরপর আরও বহু যুদ্ধ হয়েছে। এখনো চলছে সেই যুদ্ধ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৩
আপনার মতামত জানানঃ