একের পর এক বন্দুক হামলায় বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্র। বন্দুক হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না স্কুল, হাসপাতাল, গির্জা কিংবা শপিংমলের মতো স্থানগুলোও। সম্প্রতি টেক্সাসের একটি স্কুলে চালানো হামলায় প্রাণ হারিয়েছে ১৯ শিশু শিক্ষার্থীসহ ২১ জন।
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীসহ নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও অন্যান্য স্টাফদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তথা বন্দুক তুলে দিতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মূলত উত্তর আমেরিকার এই দেশটির ওহাইও অঙ্গরাজ্য শিক্ষকদের নিরাপত্তায় তাদের হাতে বন্দুক তুলে দেওয়ার একটি আইন কার্যকর করতে প্রস্তুত বলে জানানো হয়েছে।
শনিবার (৪ জুন) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স এবং সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। এতে বলা হয়েছে, স্কুলের শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মীদের ২৪ ঘণ্টার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষ করার পরে তাদের হাতে বন্দুক তুলে দেওয়া হবে এবং ওহাইও অঙ্গরাজ্য এই সংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়ন করতে প্রস্তুত।
এই আইনের সমর্থকদের আশা, নতুন এই আইনটি কার্যকরের মাধ্যমে শিক্ষকদের সশস্ত্র করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে বন্দুক হামলা হ্রাস পাবে এবং এতে করে প্রাণহানির ঘটনায় কমবে।
তবে শিক্ষকদের ইউনিয়ন এবং অঙ্গরাজ্যটির প্রধান পুলিশ অফিসার ইউনিয়ন-সহ এই বিলের বিরোধীরা বলছেন, এটি শিশুদের জন্য স্কুলগুলোকে আরও বিপজ্জনক করে তুলবে।
আলজাজিরা বলছে, টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের উভালদের একটি স্কুলে রাইফেল নিয়ে এক কিশোরের হামলার ১০ দিন পর বিলটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। বর্বর ওই হামলায় ১৯ জন শিশু শিক্ষার্থী-সহ দুই শিক্ষক নিহত হন।
ওহাইও অঙ্গরাজ্যের গভর্নর মাইক ডিওয়াইন বলেছেন, শিক্ষকদের হাতে বন্দুক তুলে দেওয়ার এই বিলে তিনি স্বাক্ষর করবেন এবং এটিকে আইনে পরিণত করবেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি একজন রিপাবলিকান এবং আলোচিত বিলটি চলতি সপ্তাহে রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত ওহাইও’র সাধারণ পরিষদে পাস হয়েছে।
বিলের সমর্থকরা বলছেন, নতুন এই আইনটি কার্যকর হলে স্কুলে হামলার সময় পুলিশ আসার আগেই সশস্ত্র আক্রমণকারীর মোকাবিলা করতে পারবেন স্কুলের কর্মীরা।
বিলের স্পন্সর ও রিপ্রেজেন্টেটিভ সদস্য টমাস হল এক বিবৃতিতে বলেছেন, আমাদের স্কুলগুলোতে জরুরি পরিস্থিতিতে প্রতিটি সেকেন্ডের গুরুত্ব রয়েছে এবং এই আইনের মাধ্যমে সম্ভাব্য ট্র্যাজেডি বা বিপর্যয় প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
আলজাজিরা বলছে, সশস্ত্র শিক্ষকদের ক্রিমিনাল ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা হবে এবং প্রতি বছর তাদেরকে আট ঘণ্টার অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে।
অবশ্য ওহাইও এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন এবং ওহাইও ফেডারেশন অব টিচার্স একটি যৌথ বিবৃতিতে দাবি করেছে, বিলটি তাড়াহুড়া করে প্রণয়ন করা হয়েছে। একইসঙ্গে বিলটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলেও দাবি করেছে তারা।
সশস্ত্র শিক্ষকদের ক্রিমিনাল ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা হবে এবং প্রতি বছর তাদেরকে আট ঘণ্টার অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দেশটিতে বন্দুক-সহিংসতা রোধে আইন পাস করার জন্য আইন প্রণেতাদের আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতীয় টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত এক আবেগঘন বক্তৃতায় তিনি এই আহ্বান জানান।
বন্দুক ইস্যুতে বাইডেন বেশ কয়েকটি আইনের প্রস্তাব করেছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে হামলায় ব্যবহার হতে পারে এমন অস্ত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা। আর বন্দুক নির্মাতাদের সুরক্ষা আইন অপসারণেরও আহ্বান জানান তিনি।
এ ছাড়া উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাগাজিনে সীমা আরোপ করার বিষয়েও মত দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
তিনি বক্তৃতায় বলেন, যে শিশুদের আমরা হারিয়েছি তাদের জন্য। যে শিশুদের আমরা বাঁচাতে পারি তাদের জন্য। যে দেশকে আমরা ভালোবাসি তার জন্য। চলুন সময়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। এখনই সময় পদক্ষেপ নেয়ার।
বাইডেন তার বক্তৃতায় বলছেন, যথেষ্ট হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র হত্যাক্ষেত্র হয়ে গেছে।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন (এনআরএ) বলছে, প্রেসিডেন্টের প্রস্তাব প্রকৃত সমাধান নয়।
এনআরএ একটি শক্তিশালী লবিস্ট গ্রুপ, যারা কিছু রাজনীতিবিদকে আর্থিক সমর্থন দিয়ে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলা ও এতে প্রাণহানির ঘটনা কিছুতেই থামছে না। গত বুধবার ওকলাহোমার তুলসায় একটি হাসপাতালে বন্দুকধারীর গুলিবর্ষণে চারজনের মৃত্যু হয়। নিহত হয় ওই বন্দুকধারী নিজেও।
এর মাত্র সপ্তাহখানেক আগেই টেক্সাসে একটি স্কুলে ভয়াবহ হামলায় নিহত হয় ১৯ শিশু শিক্ষার্থীসহ ২১ জন। রব এলিমেন্টারি স্কুলের ওই ঘটনায় কেঁপে ওঠে গোটা যুক্তরাষ্ট্র। এরপরই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে জোর দাবি উঠতে থাকে দেশজুড়ে।
এছাড়া শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া অঙ্গরাজ্যের একটি গির্জার বাইরে বন্দুকধারীর হামলায় নিহত হয়েছেন দুইজন। পরে বন্দুকধারী নিজেও নিহত হয়েছেন।এছাড়া উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে একইদিন পৃথক বন্দুক হামলায় আরও দুইজন আহত হয়েছেন।
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৬১টি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটে। যা আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের তুলনায় ৫২ শতাংশ বেশি। এফবিআইয়ের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) জানায়, গত বছর ৩০টি অঙ্গরাজ্যে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারান ১০৩ জন ও আহত হন ১৪০ জন।
২০২০ সালে ১৯ অঙ্গরাজ্যে ৪০টি বন্দুক হামলা হয়। এতে নিহত হয় ৩৮ জন ও আহত হয় ১২৬ জন। যদিও এসময় করোনার মহামারির কারণে লকডাউনের মতো কঠোর করোনা বিধিনিষেধ জারি ছিল। ২০১৭ সালে এ ধরনের ৩১টি ঘটনা ঘটে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ৩০টি করে হামলা রেকর্ড করা হয়।
২০১৭ সালের ৩১টি ঘটনায় রেকর্ড ১৪৩ জন প্রাণ হারান ও আহত হয় ৫৯১ জন। সে সময় নেভেদার লাস ভেগাসে হামলায় বহু হতাহত হয়। হোটেল রুম থেকে একজন বন্দুকধারীর হামলায় ওই ঘটনায় মারা যান ৬০ জন ও আহত হন ৪১১ জন।
যুক্তরাষ্ট্রে নিয়মিত বন্দুক হামলা ও তাতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও সেখানে বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন এখনো কঠোর করা যায়নি। মার্কিন কংগ্রেসে এ বিষয়ে কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে সেগুলো।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই কারও না কারও কাছে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য বন্দুক রয়েছে। ২০২০ সালে আমেরিকায় ৪৫ হাজারেরও বেশি মানুষ আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কিত আঘাতের কারণে মারা গেছে। গাড়ির দুর্ঘটনায় যত তরুণ মারা যায় তার চেয়ে বেশি নিহত হচ্ছে বন্দুক হামলায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্দুক হামলার উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা কঠিন এবং কঠোর নীতি প্রণয়ন করাও কঠিন। কিন্তু বন্দুক হামলার সুযোগ বন্ধ করা তেমন কঠিন নয়। শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার সারা দুনিয়াতেই আছে এবং আছে তাদের সহিংস ইচ্ছার বাহার। কিন্তু একজন সহিংস মানুষের হাতে রান্না করার ছুরি বা বেসবল খেলার ব্যাট হাতে যতটা না ভয়ংকর তারচেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে। কারণ চোখের পলকেই সে ১০০ রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে সক্ষম। আর এ পদ্ধতিটি সন্দেহাতীতভাবে লোভনীয়।
তারা বলেন, কথা খুব স্পষ্ট যে, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মালিকানা নিয়ে ক্রাইস্টচার্চ হামলার পর নিউজিল্যান্ড যে ধরণের নীতি গ্রহণ করেছে, একই রকম নীতি গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলার ঘটনা কমতে পারে। কিন্তু এভাবে সব বন্দুক হামলায় মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে না। যেমন সম্ভব হবে না সংবিধান সংশোধন করার মাধ্যমেও। যুক্তরাষ্ট্রের বন্দুক হামলার সমস্যা, ব্রাজিলের বন উজাড় হওয়া বা চীনের বায়ু দূষণের মতোই ভয়াবহ। মানবসৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় বন্ধ করা কঠিন এবং রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভবও নয়। তবে তাই বলে সাহসী মানুষের অভিযাত্রা থেমে থাকবে কেন?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৩
আপনার মতামত জানানঃ