সন্ধ্যার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো হয়ে ওঠে অপরাধের অভয়ারণ্য। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি ও খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ে রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারের ৩৪ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প এখন অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মাদক কিংবা মানব পাচার শরণার্থী ক্যাম্পের নিত্য ঘটনা। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার এবং নিজেদের অবস্থান সংহত করতে প্রায়ই অস্ত্রের মহড়া কিংবা রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা।
যখন–তখন রোহিঙ্গা নারীদের ধরে নিয়ে ধর্ষণ ও মুক্তিপণ আদায়ের জন্য অপহরণের ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এ সমস্যার সমাধান করতে পারছে না।
গত সোমবার(৩০ মে) রাত আটটার দিকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা উখিয়ার ক্যাম্প-১৭ শিবিরের এ-ব্লক থেকে অপহরণ করে রোহিঙ্গা তরুণ ফরিদ আলমকে (২৪)। খবর পেয়ে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্যরা অভিযান চালিয়ে রাত সাড়ে ১২টার দিকে শিবিরের ইরানি পাহাড়ের আস্তানা থেকে আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করেন। কিন্তু এ ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসীদের ধরা সম্ভব হয়নি।
গত ২৭ মে টেকনাফের একটি আশ্রয়শিবির থেকে আট বছর বয়সী এক শিশুকে অপহরণ করে পাশের লম্বাবিল জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৬ এপিবিএন সদস্যরা পরের দিন পাশের পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করেন ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত দুই রোহিঙ্গাকে। এপিবিএন অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম বলেন, শিশুটিকে প্রলোভন দেখিয়ে লম্বাবিল নামক জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করে গ্রেপ্তারকৃত দুই রোহিঙ্গা।
২ মার্চ রাতে টেকনাফের আরেকটি আশ্রয়শিবির থেকে এক রোহিঙ্গা তরুণীকে অপহরণ করে একদল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। এরপর একটি ঘরে আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়। ২ এপ্রিল তরুণী বন্দিদশা থেকে কৌশলে পালিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করেন। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ধর্ষণে জড়িত মোহাম্মদ দেলোয়ার নামের এক রোহিঙ্গা যুবককে গ্রেপ্তার করে।
২০২১ সালের ২২ মে রাতে উখিয়ার জামতলী ক্যাম্প থেকে এক রোহিঙ্গা তরুণীকে অপহরণ করে টেকনাফের শামলাপুল ক্যাম্পের একটি আস্তানায় আটকে রেখে চার দিন ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় তোলপাড় হয়েছিল। পরে পুলিশ ওই তরুণীকে উদ্ধার করে। ধর্ষণের অভিযোগে দুই রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হলেও এ ঘটনায় করা মামলার অনেকে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী বলেন, পাহাড়ের ঢালুতে ঘনবসতির ঝুপড়িঘরে রোহিঙ্গা নারীরা নিরাপত্তাহীন। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকে সকাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা কিশোরী-তরুণী ও যুবতী নারীদের আতঙ্কে থাকতে হয়। নারীরা রাতের বেলায় ঘরের বাইরে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলে কিংবা দূরের নলকূপ থেকে খাওয়ার পানি আনতে গেলে অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার হন। ধর্ষণের ঘটনাগুলো স্থানীয়ভাবে সালিস বৈঠকে নিষ্পত্তি করা হয়। কিছু ঘটনা বিয়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়। আর কিছু ঘটনা জরিমানায় সীমাবদ্ধ থাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গা মাঝি বলেন, এই শিবিরে মিয়ানমারের সশস্ত্রগোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সন্ত্রাসীদের আস্তানা। দিনের বেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্যাম্পে অভিযান চালালে কাঁটাতারের বেড়া ফুটো করে পাশের পাহাড়-জঙ্গলে আশ্রয় নেয় ওই সব সন্ত্রাসী। আর রাতের বেলায় ক্যাম্পে ঢুকে রোহিঙ্গা মেয়েদের অপহরণ, ধর্ষণসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। এই শিবিরে গত ১৫ দিনে অন্তত ১১ জন রোহিঙ্গা নারী ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন, কিন্তু ভয়ে কেউ থানায় মামলা করার সাহস পাননি।
উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরের ১২ লাখ রোহিঙ্গার নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে এপিবিএনের তিনটি ব্যাটালিয়ন, যার সদস্যসংখ্যা দুই হাজারের বেশি। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরবর্তী কয়েক মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই নেয় আট লাখ রোহিঙ্গা। জেলা পুলিশের তথ্যমতে, এ দেশে আসার পর পৌনে পাঁচ বছরে আশ্রয়শিবিরগুলোতে ৪ হাজার ৭০০ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ২ হাজার ৪০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১২৫ জন রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা হয়েছে ৭৬টি ও ১৮৮ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা হয়েছে ২৫টি। পৌনে ৫ বছরে আশ্রয়শিবিরে খুনের মামলা হয়েছে ৭৪টি। এসব ঘটনায় বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩৫৯ রোহিঙ্গাকে। একটি ঘটনায় সর্বোচ্চ ছয়জন রোহিঙ্গা খুনের নজিরও আছে।
নারীরা রাতের বেলায় ঘরের বাইরে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলে কিংবা দূরের নলকূপ থেকে খাওয়ার পানি আনতে গেলে অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার হন।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ক্যাম্পগুলোর ভেতরে ১৫-২০টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড। এখানে প্রতিদিন প্রায় শত কোটি টাকার ইয়াবা-আইস ও সোনা চোরাচালানের লেনদেন হয়। শুধু তাই নয়, দেশের সব ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নাকি এসব ক্যাম্প থেকেই হয়।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও কর্মীদের দাবি, অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে ১৫ থেকে ২০টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী সক্রিয়। প্রতিটি বাহিনীতে ৩০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত সদস্য রয়েছে।
সূত্র মতে, বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারা শরণার্থী ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার এবং দ্রুত ধনী হতে জড়িয়ে পড়েছে নানা অপরাধ কর্মকান্ডে। ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে নিজের অবস্থান সুসংহত করতে তৈরি করেছে অপরাধী গ্রুপ। তারা ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে আধিপত্য বিস্তার, মাদক ও মানব পাচার, অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে প্রায় সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে।
এতে প্রায়ই খুন, সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ঘটছে অপহরণের মতো ঘটনাও। এ ছাড়া ধর্ষণ, ডাকাতির ‘সাধারণ’ ঘটনায় পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ইয়াবার আখড়ায় পরিণত করেছে। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান সরাসরি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসার কারণে দেশের মাদকের অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্টেও পরিণত হয়েছে ক্যাম্পগুলো।
করোনাকালেও থেমে নেই শিশু-কিশোরী ও রোহিঙ্গা পাচার। পাচারকারীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সংকটে থাকা পরিবারের শিশু-কিশোরীদেরকেই পাচারের জন্য টার্গেট করে। গত কয়েক বছরে পাচারের ক্ষেত্রে ফেসবুক, টিকটকসহ সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভারতে ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাদের মানব পাচার চক্রের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এই নারীদের বেশির ভাগকে জোর করে যৌন পেশায় বাধ্য করা হয় বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০২০ পর্যন্ত মানব পাচারের যেসব মামলা হয়েছে তাতে দেখা গেছে, প্রায় ২ হাজার নারী মানব পাচারের শিকার হয়েছেন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০২০ সালে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমকালে উদ্ধারকৃত নারীর সংখ্যা ৩০৩ জন।
স্থানীয় জনগণ তো বটেই, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পর্যন্ত স্বীকার করা হচ্ছে যে রোহিঙ্গারা পরিবেশ নষ্ট করছে, নারী ও শিশু পাচার, মাদক পাচারসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজে যুক্ত হচ্ছে, এমনকি তারা বাংলাদেশের জন্য একটি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও প্রায় পাঁচ বছর আগের বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত, তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের বক্তব্য অস্বাভাবিক নয়। মূলত অতীতে রোহিঙ্গাবিষয়ক সিদ্ধান্ত, দূরদর্শিতার বদলে নীতিনির্ধারকদের একপেশে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা দিয়ে কতটুকু প্রভাবিত হয়েছিল, সে প্রশ্ন চলে আসে। এ প্রশ্নের উত্তরই বলে দেবে, কেন আজ রোহিঙ্গাদের বোঝা মনে হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় চোরাচালান রুট ও অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে খ্যাত উখিয়া-টেকনাফে খোদ এ দেশীয় চোরাচালানি ও অপরাধীদের বিচরণ ও কার্যক্রম যখন প্রকাশ্যে ঘটমান, তখন কিছু রোহিঙ্গা সেখানে ব্যবহৃত হবে বা নিজ উদ্যোগে সেসব ঘটনার অংশীদার হবে, এমনটা বিচিত্র নয় মোটেও। দুঃখজনক হলেও সত্য যে মানবিকতার পাশাপাশি দূরদর্শিতা নিয়ে এমন কোনো নীতি রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশে গ্রহণ করা হয়নি, যা বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের হত্যার বিচার করতে এবং মিয়ানমারকে নিজ দেশের মানুষকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করতে পারত। পেঁয়াজ থেকে আইস—বৈধ বা অবৈধ সব পথেই বাণিজ্য অব্যাহত রেখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কথা বলা অর্থহীন। বাংলাদেশ দুর্বল নয়, কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে উদারতা ও মানবিকতা দেখানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের দূরদর্শী সবল দিকটি বোধ করি প্রকাশ করার সময় হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ