আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝোলানো, ট্রাইব্যুনালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আদেশ দেয়ার পর জামায়াতের প্রতিক্রিয়া ছিল ধ্বংসাত্মক। দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরকারি-বেসরকারি সম্পদে বেপরোয়া হামলা চালানো দলটি ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে বিএনপির শরিক হিসেবে সরকার পতন আন্দোলনে নেমে খালি হাতে ঘরে ফেরার পর একেবারে কার্যালয়বিমুখ হয়ে গেছে।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মানবতাবিরোধী অপরাধে যখন থেকে জামায়াত নেতারা গ্রেপ্তার হতে থাকেন, তখন থেকে তাদের কার্যালয়ে ঝুলে যায় তালা। বছরের পর বছর ধরে সে তালা খুলছে না। অনেকটা গোপনে চলে তাদের তৎপরতা।
তবে ইদানীং হঠাৎ করেই অস্তিত্বের জানান দিতে শুরু করেছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। চলতি মাসে ঢাকায় বেশ কয়েকটি ঝটিকা মিছিল করেছেন জামায়াতের মহানগরের নেতারা। গত ফেব্রুয়ারিতেও রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বর চত্বরে একটি মিছিল হয়।
তবে মগবাজারের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বন্ধ আছে। ভবনে কেউ নেই বলে জানান কার্যালয়ের নিচতলায় থাকা নিরাপত্তাকর্মী আব্দুল কুদ্দুস। তিনি জানান, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে অফিসে কেউ আসে না বলে জেনেছেন, যদিও তার নিয়োগ আরও চার বছর পর।
কুদ্দুস বলেন, ‘আমি সাত বছর ধরে এই ভবনে চাকরি করছি। ২০১৫ সাল থেকে আমি এখানে আছি। কী কারণে এটা বন্ধ আমি কিছু জানি না। আমি জানবই বা কী করে?’
তবে বৈঠক হচ্ছে ঠিকই। জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার এক নেতা বলেন, ‘দলীয় কার্যালয় ছাড়াই কাজ চলছে আমাদের। জামায়াত একটি ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন। অফিস ছাড়াই আমরা দলের টপ টু বটম যোগাযোগ করে আসছি। তবে এ জন্য অনেক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। সাংগঠনিকভাবেও কার্যক্রম চালাতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে।’
ঝটিকা মিছিলগুলো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমান যুগে তো যোগাযোগ রাখা কঠিন না। তথ্য পাওয়ার মধ্য দিয়ে সেগুলো হয়ে যাচ্ছে। সুনির্দিষ্ট কোনো স্থানে বর্তমানে জামায়াতের মিটিং হয় না। যখন যেখানে সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই দলের মিটিং করা হচ্ছে। নেতাদের বাসায়-মসজিদে মিটিংগুলো হয়।
কার্যালয় বন্ধ থাকাতে তেমন কোনো সমস্যা হিসেবে দেখছেন না জামায়াতের প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সাংগঠনিক কাজগুলো এখন বিভিন্ন বাড়িতে বাড়িতেই হয়।
‘এ ছাড়া সাংগঠনিক কাজগুলো এখন প্রযুক্তির কল্যাণে সহজ হয়ে গেছে। মোবাইল, হোয়াটসঅ্যাপ আছে, এর মাধ্যমে…। এ ছাড়া ব্যক্তিগত যোগাযোগের জন্য তো অফিস লাগে না।’
এই জামায়াত নেতা জানান, ‘যখনই আমাদের বৈঠক করা দরকার হয় তখন বৈঠক হচ্ছে। সেখানে বড় জমায়েতের সুযোগ এখন নেই, বৈঠকগুলো ছোট পরিসরেই করা হচ্ছে।
কোথায় বৈঠক হয় এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বৈঠকগুলো বাংলাদেশের ভেতরেই মাটির ওপরেই হয়। বিভিন্ন জয়গায় বসে মিটিংগুলো হয়। মিটিং করার জন্য আমাদের এর চেয়ে বেশি কোনো জায়গার দরকার পড়ে না।’
দেশ রূপান্তরের ফেব্রুয়ারির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তৎপরতা শুরু করেছে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী। কোনো রাজনৈতিক জোটে না গিয়ে আলাদাভাবে নির্বাচন করতে চাচ্ছে দলটি। এই নিয়ে দলটির নীতিনির্ধারকরা বৈঠক করছেন। ৬৪ জেলায় ‘গোপন কমিটিও’ গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির মাধ্যমে নেতাকর্মীদের সক্রিয় করতে বলা হয়েছে কেন্দ্র থেকে।
সম্প্রতি পুলিশের একটি প্রতিবেদনেও বলা হয়, জামায়াত নির্বাচনকেন্দ্রিক পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে না গেলে সামনের দিনগুলোতে সমস্যা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
জামায়াত ও ছাত্রশিবিরসহ দলটির অঙ্গসংগঠনগুলোকে নজরদারির আওতায় আনতে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সবকটি রেঞ্জ অফিস, পুলিশ সুপার ও ইউনিট প্রধানদের কাছে বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে বলে জানায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। এরপর পাবনা জেলা জামায়াতের আমিরসহ দলটির শীর্ষস্থানীয় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড ও নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘জামায়াতের নেতাকর্মীরা গোপন বৈঠক করছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। দলটি দেশবিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত আছে। সংসদ নির্বাচন নিয়ে তারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। দলের নেতাকর্মীরা দেশের বিভিন্নস্থানে ঘাপটি মেরে আছে। তাদের প্রতিরোধ করতে সরকারের হাইকমান্ড থেকে নির্দেশনা এসেছে। পুলিশসহ অন্য সংস্থাগুলো সেইভাবে কাজ শুরু করে দিয়েছে।’
জানতে চাইলে ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, জামায়াত ও ছাত্রশিবির ঢাকাসহ সারা দেশেই নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। কয়েক মাস আগে রাজধানীর বারিধারা এলাকা থেকে জামায়াতের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, জামায়াতের নেতাকর্মী যারা বিদেশে আছেন তারা নানা অপপ্রচার চালিয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তারা সক্রিয়। তাদের প্রতিরোধ করতে যা যা করা দরকার তাই করা হবে। দেশের শান্তি বিনষ্ট করলে কঠোরভাবে দমন করা হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
পুলিশের সূত্র মতে, আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখেই জামায়াত তৎপর হয়ে উঠেছে ও প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে তারা মনে করেন। তারা নতুন কৌশলে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। পুলিশও এখন কৌশল বদলে তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে।
এমনকি ওই প্রতিবেদনের সূত্র মতে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামায়াতের এক নেতা জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই মহিলা জামায়াত সদস্যদের নিয়ে ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরে বৈঠক করা হয়েছে। বৈঠকে জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতা অংশ নিয়েছিলেন। সামনের নির্বাচনগুলোতে জামায়াত আলাদাভাবে অংশ নেবে বলে বৈঠকে জানানো হয়েছে। বিশেষ করে সংসদ নির্বাচনে কারা কারা প্রার্থী হতে পারেন তাদের তালিকা করতে বলা হয়েছে। কীভাবে দলকে আরও সংগঠিত করা যায় তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে বৈঠকে।
স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ থাকলেও জিয়াউর রহমানের বদান্যতায় রাজনীতিতে ফেরার অনুমতি পাওয়া জামায়াত এখন দলীয় কার্যক্রম চালাতে পারলেও নির্বাচন কমিশনে তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়ে গেছে।
২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এতে বলা হয়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২–এর আওতায় রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেয়া হয়। তবে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে করা ৬৩০ নম্বর রিট পিটিশনের রায়ে আদালত নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে। এরপর নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন বাতিল করে।
নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় দলীয় প্রতীকে ভোটে লড়ার যোগ্যতাও নেই জামায়াতের। অন্যদিকে তাদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের খড়্গ ঝুলছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের একাধিক রায়ে জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দেয়ার পর নেতাদের মতো দলটিরও বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। যদিও সেটি আট বছর আগের কথা। কিন্তু এর কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের জন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বিভিন্ন সময়ে বলেছিলেন, অপরাধী সংগঠনের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের সংশোধনীর খসড়া শিগগিরই মন্ত্রিসভায় উঠবে। শেষ পর্যন্ত সেটা আর মন্ত্রিসভায় ওঠেনি। ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সংগঠনের বিচারকাজও শুরু করা যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের ভূমিকা ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগীর। দলটির নেতা-কর্মীরা সে সময় গঠন করে রাজাকার বাহিনী। তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ গঠন করে খুনে বাহিনী আলবদর। এই বাহিনীর বিরুদ্ধেই আছে বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ। এসব ঘটনায়ই স্বাধীনতা-উত্তর জামায়াত হয় নিষিদ্ধ।
এসডব্লিউ/এসএস/২২১০
আপনার মতামত জানানঃ