বিশ্বের নানাপ্রান্তে শরণার্থী সংকট রয়েছে। বিশ্বে সবই যেন চলছে করোনা আর যুদ্ধ ঘিরে, শরণার্থীরা পড়ে গেছেন আড়ালে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বর্তমান বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ শরণার্থী সংকটে ভুগছে। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে রাজনৈতিক, সামরিক, জাতিগত ও মতাদর্শের নানা সংকট মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে জাতি পরিচয়, বেঁচে থাকার অধিকার।
সংঘাত, সহিংসতা, নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে বাঁচতে বিশ্বজুড়ে ১০ কোটিরও বেশি মানুষ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।
ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার অন্যতম কারণ ইউক্রেন যুদ্ধ। এছাড়া আফ্রিকার ইথিওপিয়া ও কঙ্গোতে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের কারণে অনেক মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে এবং এশিয়ার আফগানিস্তান ও মিয়ানমারেও সহিংসতার কারণে বহু মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন। বাস্তুচ্যুতির শিকার মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে নতুন করে যেসব অঞ্চল ভূমিকা রাখছে, তার মধ্যে উত্তর মোজাম্বিক, পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল উল্লেখযোগ্য।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘পৃথিবীতে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এ ধরনের রেকর্ড সৃষ্টি করা কখনোই উচিত নয়। নিরপরাধ মানুষদের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হওয়ার পেছনে যে ধ্বংসাত্মক দ্বন্দ্ব ও নিপীড়ন রয়েছে তা অবসানে সোচ্চার হতে হবে।’
ইউএনএইচসিআর যে তথ্য দিয়েছে সেখানে শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী ও নিজ দেশে বাস্তুচ্যুত মানুষেরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। একটি মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, নিজ দেশে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষের সংখ্যা গত বছরের শেষ নাগাদ ৬ কোটিতে গিয়ে ঠেকেছে।
‘পৃথিবীতে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এ ধরনের রেকর্ড সৃষ্টি করা কখনোই উচিত নয়। নিরপরাধ মানুষদের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হওয়ার পেছনে যে ধ্বংসাত্মক দ্বন্দ্ব ও নিপীড়ন রয়েছে তা অবসানে সোচ্চার হতে হবে।’
ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বাস্তুচ্যুতির কারণগুলো মোকাবিলার জন্য পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘মানবিক সহায়তা শুধু বাস্তুচ্যুতির পরিণতিগুলোর চিকিৎসা করছে। বাস্তুচ্যুতি রোধ করার একমাত্র উপায় হলো শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, যাতে নির্দোষ মানুষেরা ঘরবাড়ি ছেড়ে নির্বাসনে যেতে বাধ্য না হয়।’
ইউএনএইচসিআর জানায়, ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের কারণে দেশের অভ্যন্তরে ৮০ লাখ মানুষ তাদের বাসস্থান হারিয়েছে এবং ৬০ লাখ মানুষে অন্যদেশে পালিয়ে গেছে। গত বছর ইথিওপিয়া, বুরকিনা ফাসো, মিয়ানমার, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান ও গণ প্রজাতন্ত্রী কঙ্গোতে বাস্তুচ্যুতের সংখ্যা ৯ কোটিতে পৌঁছেছে বলে জানা গেছে।
স্থানচ্যুত মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত। একটি হলো শরণার্থী, অন্যটি বাস্তুহারা। সংঘর্ষ, নিপীড়ন বা অন্য কোনো কারণে যেসব মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়ে অন্য দেশে গিয়ে আশ্রয় খোঁজে, তারা শরণার্থী। আর যেসব মানুষ উল্লিখিত কারণে স্থানচ্যুত হয়ে নিজের দেশেই অন্য কোথাও নতুন করে আশ্রয় নেয়, তারা বাস্তুহারা।
তাদেরকে ‘ইন্টারনালি ডিসপ্লেসড পিপল’ বলা হয়, সংক্ষেপে যা আইডিপি নামে পরিচিত। আইডিপি বা বাস্তুহারার দল সাধারণত নিজ দেশের ভেতরই কোথাও অবস্থান করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরোনো ভিটার কাছাকাছি এলাকায় শিকড় গাড়ে তারা। এর অন্যতম কারণ গৃহকাতরতা।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, আগামী দিনগুলোতে বাস্তুহারা ও শরণার্থীর সংখ্যা বাড়বে। এর মূল কারণ যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সম্পর্কের টানাপোড়েন অনেক আগেই থেকে আশান্তির ধোঁয়া ওগরাচ্ছে। এর মধ্যে সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সাম্প্রতিক বৈরিতা নতুন করে বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে।
ইসরায়েলও ইরানকে একহাত নিতে একপায়ে খাড়া। কারণ, উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে এখন ইরানই তাদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। ইরান আরো শক্তিশালী হলে ছোট্ট একটি দেশ হয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের ছড়ি ঘোরানো বন্ধ হয়ে যাবে। ইয়েমেনে চলছে শিয়া ও সুন্নির ক্ষমতা দখলের লড়াই। সেখানেও ইরান ও সৌদি জোটের সশস্ত্র বিরোধ সুস্পষ্ট।
গৃহযুদ্ধকবলিত সিরিয়ায় যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। বরং দেশটি নিয়ে আমেরিকা ও রাশিয়ার মতো শীর্ষ পরাশক্তি রশি টানাটানি করছে। সে দেশ পুরোটাই এখন ধ্বংসস্তূপ। বাসযোগ্য এলাকা বা বাসাবাড়ির বড়ই অভাব।
আছে খাবারসহ নিত্যপণ্যের সংকট। কাজেই সিরিয়া থেকে আরো মানুষ পালাবে। দক্ষিণ এশিয়ায়ও পাওয়া যাচ্ছে অশান্তির গরম নিঃশ্বাস। আফ্রিকার কয়েকটি দেশ, লাতিন আমেরিকার ভেনেজুয়েলা, কলম্বিয়া, বলিভিয়া, মেক্সিকোতে শান্তি নেই। এমন অবস্থা চলতে থাকলে এখান থেকেও অনেক মানুষ অন্যত্র সরে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৫
আপনার মতামত জানানঃ