চীনের সেই যাত্রীবাহী বিমানটি ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ মাটিতে আছড়ে ফেলে বিধ্বস্ত করানো হয়েছিল। বিমানটির ককপিটে থাকা কেউ একজন এই কাজটি করেছেন। বিধ্বস্ত বিমানের ব্ল্যাক বক্স থেকে পাওয়া ফ্লাইট ডেটায় প্রাথমিকভাবে এমনটাই দেখা গেছে।
দুর্ঘটনার প্রায় দুই মাস পর এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে তদন্তে। ভয়ঙ্কর সেই বিমান দুর্ঘটনায় মোট আরোহীর ১৩২ জনই নিহত হয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা ও রয়টার্স এই তথ্য জানিয়েছে।
চলতি বছরের ২১ মার্চ মাঝ আকাশ থেকে হঠাৎ নিচে আছড়ে পড়েছিল চীনের ওই যাত্রীবাহী বিমান। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় রক্ষা পাননি কোনো আরোহীই। গভীর জঙ্গলে প্রায় সপ্তাহখানেক খোঁজ চালানোর পর উদ্ধার করা হয় বিমানের ব্ল্যাক বক্স। আর এই ব্ল্যাক বক্সই প্রাথমিকভাবে খতিয়ে দেখার পর চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
মূলত বিধ্বস্ত সেই বিমানের ব্লাক বক্সের তথ্য বিশ্লেষণ করে ইচ্ছাকৃতভাবে মাটিতে বিমান আছড়ে ফেলার তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তে পাওয়া তথ্যের বিষয়ে জানেন এমন দু’জনের বরাত দিয়ে বুধবার (১৮ মে) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স ও আলজাজিরা।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই জানানো হয়, মার্চ মাসে দুর্ঘটনাকবলিত ওই বিমানটিকে ইচ্ছাকৃতভাবে মাটির দিকে নাক বরাবর নামিয়ে আনা হয়েছিল, যে কারণে এই দুর্ঘটনাটি ঘটে।
এছাড়া চলতি সপ্তাহে মার্কিন সংবাদমাধ্য্যম দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্কিন কর্মকর্তা জানান, ব্ল্যাক বক্স থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী— কোনো দুর্ঘটনা বা নিয়ন্ত্রণহীনতা নয়, ককপিট থেকে ইচ্ছাকৃতভাবেই বিমানটিকে প্রবল গতিতে মাটির দিকে নামিয়ে আনা হয়েছিল।
‘দুর্ঘটনা’র কবলে পড়া ওই বিমানটি ছিল মার্কিন বিমান প্রস্তুতকারক সংস্থা বোয়িংয়ের তৈরি। তাই ‘দুর্ঘটনা’র তদন্তে নেমে ব্ল্যাক বক্স খতিয়ে দেখে তারা। আর এরপর মার্কিন কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে, ‘ইচ্ছে করে’ মাটির দিকে ধেয়ে গিয়েছিল বিমানটি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তদন্তকারীর বরাত দিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের দাবি, ‘ককপিট থেকেই কারোর নির্দেশে বিমানটি পরিচালনা করা হচ্ছিল।’
কোনো দুর্ঘটনা বা নিয়ন্ত্রণহীনতা নয়, ককপিট থেকে ইচ্ছাকৃতভাবেই বিমানটিকে প্রবল গতিতে মাটির দিকে নামিয়ে আনা হয়েছিল।
এর আগে চীনের পক্ষ থেকে এই ‘দুর্ঘটনা’র একটি প্রাথমিক রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানে দাবি করা হয়েছিল, বিধ্বস্ত ওই বিমানে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না। আর এরপরই নাশকতার তত্ত্ব আরও জোরালো হয়। মনে করা হচ্ছে, বিমানে থাকা কেউ একজন জোর করে ককপিটে প্রবেশ করে এই ‘দুর্ঘটনা’ ঘটিয়ে থাকতে পারে।
পশ্চিমা ওই কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে বিমানটির যান্ত্রিক কোনো ত্রুটি খুঁজে না পাওয়ায় ক্রু সদস্যদের কর্মকাণ্ডের ওপর মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।
এও জানা গিয়েছে, দুর্ঘটনা চালকের নিয়ন্ত্রণহীনতার জন্য ঘটেছে, এরকম মনে করার মতো তথ্য মেলেনি। বরং ইচ্ছাকৃতভাবেই সেটিকে লম্বভাবে মাটির দিকে নামিয়ে আনা হয়েছিল। দেখা গিয়েছে বিমানটি প্রায় ৯০ ডিগ্রি কোণেই আকাশ থেকে নেমে এসে আছড়ে পড়েছিল মাটিতে।
কিন্তু কেন তা করা হল? এখনও পর্যন্ত এব্যাপারে ধোঁয়াশাতেই রয়েছেন তদন্তকারীরা। জানা গিয়েছে, চালক ও তার সহকারীদের কারও স্বাস্থ্যজনিত কোনও সমস্যা ছিল না। কারওই অর্থনৈতিক কিংবা পারিবারিক কোনও সমস্যা থাকার কথাও জানা যায়নি। ফলে তাদের কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বিমানটিকে ক্র্যাশ করাবেন সেই সম্ভাবনা নেই।
এও জানা গিয়েছে, বিমান থেকে কোনও আপৎকালীন সংকেতও পাঠাননি চালক। এই সব তথ্য খতিয়ে দেখে মনে করা হচ্ছে, কেউ হয়তো ককপিটে ঢুকে পড়ে তা দখল করেছিল। এবং তারপর ইচ্ছাকৃত ভাবেই বিমানটিকে ক্র্যাশ করিয়েছিল।
দুর্ঘটনার পরে ভাইরাল হয়েছিল বিমানটির শেষ তিন মিটিরে হাড়হিম ভিডিও। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছিল, মাঝ আকাশ থেকে একেবারে ৯০ ডিগ্রি কোণে অর্থাৎ নাক বরাবর মাত্র ২ মিনিট ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে ২৯০০০ ফুট থেকে সোজা ৯ হাজার ৭৫ ফুটে নেমে আসে বিমানটি। এরপর মাত্র ২০ সেকেন্ডে আরও ৩২২৫ ফুট নামতেই বিমানের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
প্রসঙ্গত, গত মার্চে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের বিমানটি চীনের কুনমিং থেকে গুয়াংজুতে যাওয়ার পথে বিধ্বস্ত হয়। বিমানটি ক্রুজিং অ্যালটিটিউড (বিমান চলার আদর্শ উচ্চতা) থেকে হঠাৎই নিচের দিকে পড়ে গুয়াংজির পাহাড়ে বিধ্বস্ত হয়। এতে বিমানে থাকা ১২৩ যাত্রী এবং ৯ ক্রু সদস্যসহ সবাই নিহত হন। গত ২৮ বছরের মধ্যে চীনের এটা সবচেয়ে ভয়াবহতম বিমান দুর্ঘটনা।
বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স বোয়িংয়ের একই মডেলের বিমান ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। পরে এপ্রিলের মাঝামাঝিতে পুনরায় ব্যবহার শুরু করে। গত মাসে চীনের নিয়ন্ত্রকরা ওই বিমান দুর্ঘটনার ব্যাপারে প্রাথমিক সারসংক্ষেপ প্রকাশ করে। তবে সেখানে বিমানটির কোনো যান্ত্রিক ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, শক্তিশালী নিরাপত্তা রেকর্ডসহ এই মডেলের বিমানটি ১৯৯৭ সাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
গত ১০ মে এনটিএসবির প্রধান জেনিফার হোমেন্ডি রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এনটিএসবির তদন্তকারি এবং বোয়িংয়ের পক্ষ থেকে প্রতিনিধদল চীনা তদন্তে সহযোগিতা করতে চীনে গিয়েছিলেন। এ সময় তিনি উল্লেখ করেন, এখন পর্যন্ত তদন্তে বিমানটির নিরাপত্তাজনিত কোনো ইস্যু সামনে আসেনি যার জন্য এই মডেলের বিমানের ক্ষেত্রে জরুরি কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১২
আপনার মতামত জানানঃ