করোনার প্রভাব কাটিয়ে দুই বছর পর মাঠে ফিরেছে রাজনীতি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, সরকারবিরোধী প্রধান দল বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা এবার নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় ঈদ করেছেন।
আগামী ডিসেম্বরের সম্মেলন ঘিরে দলে শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি। আর ঝিমিয়ে পড়া কর্মীদের চাঙা করতে এবারের ঈদে এলাকায় ছুটে গেছেন বিএনপির অনেক কেন্দ্রীয় নেতা।
আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজেদের রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণে কাজ শুরু করেছে শাসক দল আওয়ামী লীগ৷ আর বিএনপি কাজ করছে বৃহত্তর ঐক্য গঠন নিয়ে৷ এদিকে জাতীয় পার্টিও পিছিয়ে নেই৷ আপাতত কোনো জেটে যেতে চায় না দলটি বরং আগামী নির্বাচনে নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি দেখানোর কথাই ভাবছে৷
আওয়ামী লীগের কৌশল নির্ধারণ
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন শফিক বলেন, “সম্প্রতি শেষ হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অনেকেই বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। অনেকেই দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। আগামী ডিসেম্বরে আমাদের যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে দলের বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নিয়েছেন তারা যেন না আসতে পারেন সে ব্যাপারে দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। ফলে আমরা সেই সব নেতাদের তালিকা তৈরি করছি। আগামী ৭ মে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের বৈঠকে প্রত্যেক বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক তাদের নিজের এলাকার রিপোর্ট উপস্থাপন করবেন। আমরা ওই রিপোর্টে দলে অনুপ্রবেশকারী বা দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নিয়েছেন তাদের বিষয়টি তুলে ধরব। পাশাপাশি যেসব জায়গায় কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, ওই সব এলাকায়ও ডিসেম্বরের আগে কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি করা হবে।”
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে শনিবার বিকেলে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা বসে৷ বৈঠক শুরুর আগে দলটির তিন জন সাংগঠনিক সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট হওয়া গেছে যে, আওয়ামী লীগ আশা করছে তাদের অন্যতম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে৷
তবে বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে সেক্ষেত্রে কীভাবে নির্বাচন করা হবে তাও তারা এখনই ঠিক করে রাখতে চায়৷ আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা হলো কেউ নির্বাচনে না এলেও যথা সময়ে নির্বাচনের আয়োজন করা এবং কেউ নির্বাচন প্রতিহত করতে চাইলে তা মোকাবিলা করা৷
আর সম্ভাব্য এসকল পরিস্থিতি সামলাতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যে ইস্যুগুলো রয়েছে তা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে সে কৌশলও তারা বিবেচনা করছে৷
দুই বছরেরও বেশি সময় পর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সকল সদস্যদের উপস্থিতিতে শনিবার এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়৷ আর এই বৈঠকে সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছেন সাংগঠনিক সম্পাদকরা৷ তারা বৈঠক শুরুর আগে শনিবার নিজেদের মধ্যে প্রস্তুতি বৈঠকও করেছেন৷
দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক (রংপুর) সাখাওয়াত হোসেন শফিক জানান, ‘‘আওয়ামী লীগের আগামী জাতীয় কাউন্সিলের আগে আমরা তৃণমূল পর্যায়ে যে কমিটিগুলো এখনো মেয়াদোত্তীর্ণ সেগুলো নতুন করে গঠন করব৷ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে দলের প্রধান শেখ হাসিনা আমাদের নির্দেশনা দেবেন৷ তার নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সারাদেশে কাজ করব৷ নির্বাচনে আমাদের কৌশল কী হবে তাও তিনি আমাদের বলে দেবেন৷’’
আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম) আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগের মূল শক্তিই হলো তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা৷ তারাই নির্বাচনে, প্রচারে, আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা পালন করে৷ এবারও তাই হবে৷ আমরা বা তারা বলে কিছু নেই৷ সবাই মিলেই আওয়ামী লীগ৷’’
নিজেদের দলীয় অবস্থান শক্তিশালী করার পাশাপাশি বিএনপি এবং জামায়াতকে নিয়ে আওয়ামী লীগের বৈঠকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে৷
তিনি বলেন, ‘‘জামায়াতের নিবন্ধন না থাকলেও তারা তো বিএনপির সাথে আছে৷ আশা করি সবাই নির্বাচনে আসবে৷ কিন্তু কেউ যদি নির্বাচনকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে তাহলে রাজনৈতকিভাবে প্রতিহত করা হবে৷’’
সাংগঠনিক সম্পাদক (বরিশাল) আফজাল হোসেন জানান, ‘‘জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সব ইস্যুই আওয়ামী লীগ নজরে রাখছে৷ এগুলো নিয়ে কৌশল নির্ধারণও করা হচ্ছে৷ আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য যা করা দরকার তার সব প্রস্তুতিই আমরা নিচ্ছি৷’’
র্যাব ও পুলিশের ছয় কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর আর যাতে নতুন করে কেউ কোনো নিষেধাজ্ঞার মুখে না পড়ে সেদিকেও সতর্ক হচ্ছে আওয়ামী লীগ৷ আর এর জন্য তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রচার জোরদার করছে তারা৷ একই সঙ্গে দ্রব্যমূল্য নিয়েও তারা বিভিন্ন মাধ্যমে কথা বলবে বলে জানা গেছে৷
জাতীয় পার্টির সাথে মহাজোট নিয়ে এখনো ভাবছে না আওয়ামী লীগ৷ তবে নির্বাচন এগিয়ে এলে পরিস্থিতির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে বলে জানান এই নেতারা৷ তবে ১৪ দলীয় জোটকে আরো সক্রিয় করা হচ্ছে৷
বিএনপির ঐক্যের চেষ্টা
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন ও আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হয়েছেন এলাকামুখী। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কুশল ও শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন তারা। ঈদ উপহার বিতরণের পাশাপাশি ইফতার মাহফিলে অংশ নিয়ে গণসংযোগ করেছেন, চা-চক্রসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। মনোনয়ন প্রত্যাশীরা দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে সাধ্যমতো সহায়তা করছেন।
এদিকে বৃহত্তর জোট গঠনের ঘোষণা দিলেও এখন জোট নয় বরং বৃহত্তর ঐক্য করতে চায় বিএনপি৷ জাতীয় সরকার নির্বাচনের আগে না পরে এই ইস্যুতে ঐকমত্য না হওয়ায় বিএনপি বৃহত্তর জোটের চিন্তা থেকে সরে এসেছে৷
দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘‘এই সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন; এই মিনিমাম ইস্যুতে আমরা একমত হয়ে সমমনা দলগুলোকে নিয়ে ঐক্য করার কাজ করছি৷ জোট হবে কী হবে না তা নির্ভর করবে ঐক্য হওয়ার পর৷ আর নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে আন্দোলনে থাকা সব দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করবে৷’’
জানা গেছে, এই বৃহত্তর ঐক্যে কোনো দল আলাদাভাবে বা ছোট ছোট দল জোট করেও থাকতে পারবে৷ সমন্বয়ের মাধ্যমে কর্মসূচি দিয়ে আলাদা আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করবে তারা৷ ঐক্যের গঠনের প্রক্রিয়া শেষ হলে বিএনপি বড় কোনো কর্মসূচি দেয়ার কথা ভাবছে৷
এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘‘আমরা তো এমনিতেই চাপের মুখে আছি৷ আন্দোলন-সংগ্রাম করলে চাপ আসবেই৷ নির্বাচনের আগে যদি চাপ আরো বাড়ে তাহলে আমরা জনগণকে সাথে নিয়ে তা মোকাবিলা করব৷ আমরা কোনোভাবেই এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না৷ নির্বাচন হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে৷’’
৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে চায় জাতীয় পার্টি
জাতীয় পার্টি এখনই প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শুরু করেছে৷ কোনো জোট থেকে নয় বরং এককভাবে নির্বাচন করতে চায় দলটি৷
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু জানান, ‘‘নির্বাচনের পর মহাজোটের আর কোনো অস্তিত্ব নাই৷ ওটা ছিলো একটি নির্বাচনী জোট৷ আবার এই জোট হবে কি না বা তারা কোন দিকে যাবে, আওয়ামী লীগ না বিএনপি, তা সময়ই বলে দেবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা ৩০০ আসনেই নির্বাচনে প্রার্থী দেয়ার কাজ শুরু করেছি৷ যেখানে আমাদের ভালো প্রার্থী নাই সেখানে আমরা যোগ্য লোকজন যারা আসতে চান তাদের নিচ্ছি৷’’
সাংগঠনিক কার্যক্রমও জোরদার করেছে দলটি৷ বর্ধিত সভা করে দলটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আগামী জুন মাসের মধ্যে বিভাগীয় পর্যায়ে, এরপর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সভা করা হবে সেপ্টেম্বরের মধ্যে৷ তারপর ঢাকায় মহাসমাবেশ করবে তারা৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩৫
আপনার মতামত জানানঃ