দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি গোয়েন্দা সংস্থা হচ্ছে সামরিক গোয়েন্দা মহাপরিদফতর (ডিজিএফআই)। ডিজিএফআই সাধারণত প্রতিরক্ষা বিষয়ে ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় গোয়েন্দা কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। ডিজিএফআইয়ের অধীনেই ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো বা কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মতো একাধিক ইউনিট রয়েছে।
সামরিক বাহিনীতে চাকরিরত যেকোনো সদস্যকেই গোপন নজরদারিতে থাকতে হয়। দায়িত্বের গুরুত্বের উপর নির্ভর করে নজরদারির মাত্রা, আর সে অনুযায়ী তৈরী করা হয় ওই কর্মকর্তার গোয়েন্দা প্রতিবেদন।
যা কমান্ডিং অফিসার, ফর্মেশন কমান্ডার বা যে সংস্থায় কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন সে সংস্থার প্রধান কর্তৃক পৌছে যায় নীতি-নির্ধারকদের কাছে, আল্টিমেটলি ওই কর্মকর্তার ক্যারিয়ার প্রগ্রেসের অন্যতম মূল মাপকাঠি হিসেবে বিচার করা হয় এই প্রতিবেদন।
এক শ্রেনীর কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অত্যন্ত পেশাদার কর্মকর্তাদের নিজ বশে আনতে প্রচলন ঘটেছে গোয়েন্দা প্রতিবেদন তৈরী করে তা কর্মকর্তার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষর কাছে প্রেরণ করা ও এই রিপোর্টের ব্যবহার করে তার ক্যারিয়ার ধ্বংসের হুমকি দেয়া, অতঃপর তাকে দিয়ে জোরপূর্বক বিভিন্ন অন্যায়-অন্যায্য কাজ করানো।
সম্প্রতি একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার বিশ্বস্ত সুত্র থেকে এ বিষয়টির পক্ষে একটি অত্যন্ত জোড়ালো প্রমান এসেছে।
সেখানে দেখা যাচ্ছে, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এর মহাপরিচালক; র্যাব ইন্টেলিজেন্স উইং কর্তৃক সম্পাদিত একটি বিস্তারিত গোয়েন্দা প্রতিবেদন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সামরিক সচিব বরাবর প্রেরণ করেছেন।
চিঠিতে ও সংযুক্ত গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, রিপোর্টের বিষয় তৎকালীন লেঃ কর্নেল মোঃ আনোয়ার লতিফ খান, পিএসসির; কমান্ড ব্যর্থতা, অপারেশন প্ল্যানিং এ অদূরদর্শিত, আইনশৃংখলা রক্ষায় চরম ব্যর্থতা, ব্যক্তিগত সেচ্ছাচারিতা ইত্যাদি নানা অভিযোগের কারণে তার সংস্থার প্রধান বা ডিজি র্যাব, সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছেন যেন এই কর্মকর্তাকে তার নিজ বাহিনী যাকে সামরিক ভাষায় মাতৃবাহিনী বলা হয়, সেখানে ফেরত নেয়ার জন্যে।
প্রথাগতভাবে সামরিক সচিবের কার্যালয় যখন এমন একটা চিঠি পায় তখন কর্মকর্তাকে নিজ বাহিনীতে দ্রুত ফিরিয়ে নিয়ে লগ এরিয়ায় সংযুক্ত করে, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের গুরুত্ব অনুযায়ী অফিসারের কোর্ট অফ ইনকোয়েরির আয়োজন করে।
আনোয়ার লতিফের বেলায় আনা অভিযোগগুলোও বেশ শক্ত প্রকৃতির, তাকেও এই কোর্ট অফ ইনকোয়েরির মুখামুখি হতে হতো, বোর্ড সন্তুষ্ট হলে চাকুরী হয়তো টিকে যেতো কিন্তু পরবর্তী পদোন্নতীর ক্ষেত্রে বেশ কাঠ-খড় পোড়াতে হতো। কিন্তু আদৌ কি তা হয়েছে?
র্যাব ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের তৎকালীন পরিচালক লেঃকর্নেল জিয়াউল আহসানের তত্ত্বাবধানে প্রস্তুত করা স্মারক নং ৪০৩/র্যাব/ ইন্ট/ গোয়েন্দা প্রতিবেদন/১৩১৫, ঠিকই পৌছে যায় সামরিক সচিবের কার্যালয়, কিন্তু কার্যকরী কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। কারন গোয়েন্দা সুত্র অনুযায়ী, জিয়াউল আহসান খুবই চতুরতার সাথে ওই অফিসারকে এই চিঠির কপি দেখিয়ে (যেটা একেবারেই সামরিক নিয়মের পরিপন্থী) নিশ্চয়তা আদায় করে নেন যে— লেঃ কর্নেল মোঃ আনোয়ার লতিফ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে যতদিন চাকুরী করবেন ততদিন তাকে যে আদেশই করা হবে, তিনি তাই পালন করবেন। আদেশ হোক নৈতিক বা অনৈতিক, তিনি সে বিষয়ে কোন রকমের অপারগতা প্রকাশ করতে পারবেন না।
গোয়েন্দা সূত্র আরো দাবী করেছে যে, এই পন্থায় আরো বহু পেশাদার ও চৌকষ সেনা কর্মকর্তাদের নিজ কবজায় নিয়েছেন বর্তমানের এনটিএমসির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল আহসান।
এই চিঠির পরেও লেঃ কর্নেল মোঃ আনোয়ার লতিফ’কে সেনাবাহিনী’তে ফেরত পাঠানো হয়নি, তিনি র্যাব ৫, ৭ ও ১১’র অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন ও র্যাবে থাকা অবস্থায় কর্নেল হিসেবে পদোন্নতিও লাভ করেন।
আর এই পদোন্নতির পর তিনি এপ্রিল ২০১৬ তারিখে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস্) এর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, এই পদটিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ বলে বিবেচনা করা হয়।
এই পন্থায় আরো বহু পেশাদার ও চৌকষ সেনা কর্মকর্তাদের নিজ কবজায় নিয়েছেন বর্তমানের এনটিএমসির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল আহসান।
কর্নেল আনোয়ার লতিফ সেপ্টেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত এই অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন, পরবর্তীতে তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এস আই এন্ড টি’র কর্নেল এডমিন হিসেবে বদলী করা হয়।
২০১৯ এর জানুয়ারি মাসে র্যাবে কর্মরত থাকা অবস্থায় অসীম সাহসিকতার পুরস্কার হিসেবে তাকে বাংলাদেশ পুলিশ পদক বা বিপিএম দেয়া হয় বলে প্রজ্ঞাপন জারী করা হয়।
২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে কর্নেল মোহাম্মদ আনোয়ার লতিফ খানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
আল-জাজিরার অনুসন্ধানী দলের সদস্য ও অধিকারকর্মী জুলকারনাইন সায়ের খান ওরফে সামি তার এক ফেসবুক পোস্টে বিষয়টা তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি এবিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন রেখেছেন:—
১. নেতিবাচক গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাঠানোর পরেও কেন এই কর্মকর্তাকে নিজ বাহিনীতে ফেরত পাঠানো হয়নি ও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি?
২. নেতিবাচক গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পরেও তিনি কিভাবে ২৬ লং কোর্সের ফার্স্ট লটের মধ্যে পদোন্নতি পেলেন (একটা কোর্সের সবাই একসাথে পদোন্নতি পায় না, তার কোর্সে কর্নেল পদোন্নতী প্রাপ্ত প্রথমদের মধ্যে তিনি ছিলেন) কিভাবে?
৩. যে কর্মকর্তার ব্যাপারে ডিজি নিজেই চিঠি সাক্ষর করে পাঠালেন সেই কর্মকর্তাকে কিসের প্রেক্ষিতে আবার ওই র্যাবেই গুরুত্বপূর্ণ এডিজি (অপস) হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো এবং বিপিএম পদক দেয়া হলো?
৪. গোয়েন্দা প্রতিবেদনের অভিযোগগুলো যদি বানোয়াট হয় তাহলে মিথ্যা গোয়েন্দা প্রতিবেদন তৈরীর জন্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কি দোষী হবেন না?
৫. একটি অত্যন্ত পেশাদার বাহিনীতে যে লাগামহীন সেচ্ছাচারিতা ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন চলছে, তার নিরসনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ কি আদৌ কোন উদ্যোগ গ্রহণ করবেন?
সামি বলছেন, বর্তমান আওয়ামী সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশের সকল নিরাপত্তা সংস্থায় ব্যাপক আকারে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে, পেশাদারিত্বের পরিবর্তে ব্যক্তির রাজনৈতিক মতাদর্শ, আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য এবং নিয়ম ভঙ্গ করে এমন সব কাজ করতে বাধ্য করা যা দেশের প্রচলিত আইন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১২
আপনার মতামত জানানঃ