বিশ্বজুড়ে গত দু’বছরে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে করোনাভাইরাস। তবে এই সময়ে শিশুদের মধ্যে ভাইরাসটি সংক্রমণের তেমন বেশি দেখা যায়নি। মহামারির একেবারে শুরুর দিকে প্রবীণরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। ডেল্টা স্ট্রেনে মাঝবয়সিদের বেশি ভুগতে দেখা গেছে। বর্তমানে ওমিক্রন স্ট্রেনে ছোটদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের ঘটনা বেড়েছে। ওমিক্রনে প্রাণসংশয় হয়তো কম, কিন্তু চিন্তা বাড়াচ্ছে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
করোনার থাবায় নাকাল বিশ্ববাসী। ভাইরাসটির তাণ্ডব কিছুদিন আগেও যেখানে নিম্নমুখী ছিল, কিন্তু সম্প্রতি শনাক্তের হার বেড়েছে। নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বড় ধরনের চাপের মুখে ফেলেছে।
গত কয়েক দিন ধরে বিশ্বে করোনায় মৃত্যু ও শনাক্ত কিছুটা কমতির দিকে থাকলেও আবার তা বেড়েছে। এ অবস্থায় কোভিড থেকে সেরে উঠলেও শিশু রোগীদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে নানা সমস্যা।
নভেল করোনাভাইরাস একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে নাকি মানব জীবনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে থেকেই যাবে তা এখনো নিশ্চিত করতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এই মহামারির ছাপটা যে অনেক বিস্তৃত হবে তা বেশ ভালোমতোই টের পাওয়া যাচ্ছে।
সম্প্রতি কভিড-১৯ মহামারি নিয়ে করা কিছু গবেষণা থেকেও মিলেছে তেমন তথ্য। গবেষণা বলছে, নভেল করোনাভাইরাস মহামারি শিশু ও কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। আগের আরো ১৭টি গবেষণার ভিত্তিতে এমন কথা বলছেন গবেষকরা। যদিও এসব তথ্য নিশ্চিত করার জন্য আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। অনলাইন সাইট মেডআরএক্সআইভিতে প্রকাশিত এ গবেষণার ফলাফল এখনো পিয়ার রিভিউর জন্য অপেক্ষায় রয়েছে।
গবেষণার নমুনা হিসেবে নেয়া ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রকাশিত সেসব গবেষণায় দেখা গেছে, মহামারিকালে শিশু ও কিশোর বয়সীদের মধ্যে উচ্চমাত্রায় উদ্বিগ্নতা, হতাশা, ঘুমের ব্যাঘাত, আত্মহত্যা প্রবণতা, মানসিক চাপের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যাধি, মনোযোগের ঘাটতি অথবা হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডার এবং অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হয়েছে।
গবেষণা থেকে আরো জানা গিয়েছে, এ বয়সীদের আরো ব্যক্তিগত আচরণ যেমন শখ, প্রার্থনা করা বা গান শোনার মতো বিষয়গুলো মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।
গবেষণার সহলেখক টেক্সাস এঅ্যান্ডএম ইউনিভার্সিটির ড. এম মাহবুব হোসেইন বলেন, যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা অনুন্নত, যাদের সামাজিক যোগাযোগ ও সমর্থনের অভাব রয়েছে, প্রতিকূল পারিবারিক পরিস্থিতি রয়েছে এবং চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা হওয়ার প্রবণতা আরো বেশি দেখা গেছে। স্কুল বন্ধ থাকাটা এ সময়ে আরো বেশি প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। সেই সঙ্গে যারা পরিবারে বা নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে কারো নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্যর ওপর প্রভাব পড়তে দেখেছে তাদের মানসিক চাপ বেশি তৈরি হয়েছে।
এ বয়সীদের আরো ব্যক্তিগত আচরণ যেমন শখ, প্রার্থনা করা বা গান শোনার মতো বিষয়গুলো মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।
মহামারি চলার সময়ে বিভিন্ন জায়গায়, স্কুলে এবং নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য উপাদান ও সেবা খুবই অপ্রতুল ও দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। ফলে শিশু-কিশোরদের জন্যও সঠিক সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া কঠিন হয়ে ওঠে বলেই মন্তব্য করেন হোসেইন।
তিনি বলেন, শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মহামারী যে প্রভাব বিস্তার করেছে তার ফলে তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক পরিণতি উপশম করতে বহুমুখী প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
তবে এত সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করার সত্ত্বেও এখনো কভিড-১৯ মহামারির প্রভাব প্রতিরোধের বিষয়ে সচেতনতা এবং অ্যান্টি-কভিড ওষুধ গ্রহণের প্রবণতা সবার মধ্যে কম। উচ্চঝুঁকিতে থাকা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী যাদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি তাদের ২ শতাংশেরও কম অসুস্থতার মাত্রা সীমিত রাখতে সাহায্য করতে সক্ষম ওষুধ খেয়েছেন।
গবেষকরা ২০২২ সালের মার্চে বিশ্বের ৩৭টি দেশে ১ হাজার ১৫৯ জনকে বেছে নেন, পিসিআর টেস্টে যারা সার্স কভ-২ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের প্রশ্ন করা হয় তারা এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি অথবা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ মেরেক অ্যান্ড কো-এর বানানো মলনুপিরাভির বা ফাইজারের বানানো প্যাক্সলোভিড সম্পর্কে জানেন কিনা বা সেসব ওষুধ গ্রহণ করেছেন কিনা?
গবেষণায় অংশ নেয়া ২৪১ জনের মধ্যে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী ৬৬ শতাংশ এ ধরনের চিকিৎসার বিষয়ে জানতেন এবং ৩৬.৩ জন এ ধরনের চিকিৎসার বিষয়ে খোঁজ চালিয়েছেন এবং মাত্র ১.৭ শতাংশ এসব ওষুধ খেয়েছেন বলে জানান।
তবে এ ভাইরাসের সংক্রমণে তীব্রতর অসুস্থতা থেকে রক্ষা পেতে এসব ওষুধের বিষয়ে আরো বেশি সচেতন হওয়া জরুরি বলে মনে করছেন গবেষকরা। বিশেষ করে স্বাস্থ্যকর্মী এবং সম্মুখসারির কর্মীদের মধ্যে তীব্রতর অসুস্থতা ও মৃত্যুহার কমানোর জন্য এসব প্রতিরোধমূলক ওষুধ বিষয়ে জানাশোনা আরো বেশি দরকার বলেই মনে করেন তারা।
সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসায় প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস নিয়ে জনমনে উদ্বেগ কিছুটা কমেছে। তবে গত দুই বছরে মানুষের মনের গভীরে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে সময় লাগবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ কারোনাকালে অর্থনৈতিক সংকট বেড়েছে। চাকরি হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তায় পড়েছেন অনেকে। প্রিয়জনের সংক্রমণ ও মৃত্যু, বেকারত্ব এবং জীবনযাপনের স্বাভাবিক পরিস্থিতি না থাকায় মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে এই সময়ে।
করোনাকালের শুরু থেকেই অর্থনৈতিকভাবে সংকটে পড়া বা অনিশ্চিত জীবন নিয়ে ভীত হয়ে উদ্বেগ ও বিষণ্নতায় ভোগা মানুষদের কথা বহুবার আলোচনা হয়েছে। নানান শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে এ বিষয়ে গবেষণাও হয়েছে বিস্তর। তবে দুই বছর পেরিয়ে গেলেও নতুন নতুন গবেষণা বলছে, মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্নতা বাসা বাঁধছে নতুনভাবে। ঘুণ পোকার মতো তা ক্ষয় ধরাচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যে। এই বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থার বড় আঘাত পড়েছে বাংলাদেশেও। এক গবেষণা বলছে, করোনাকালে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্নতায় বাংলাদেশ শীর্ষে।
করোনাকালের ধকল কাটিয়ে সংকটে থাকা ব্যক্তিরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে তো- এ প্রশ্ন অনেকের। সঠিক পরিচর্যা পেলে মানসিক সংকটে থাকা ব্যক্তিরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, মানসিক সংকটে থাকা ব্যক্তিদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
তারা বলেন, করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় মানসিক চাপ বেড়ে যায়। পরিবারের সদস্যদের সংক্রমিত হওয়ার ভয়, নিজে সংক্রমিত হলে চিকিৎসার সুযোগ মিলবে কিনা, তা নিয়ে মানসিক চাপ তৈরি হয়। একই সঙ্গে সংক্রমিত হয়ে আইসোলেশনে থাকাকালীন একাকিত্ব নিয়েও ছিল আতঙ্ক। এ ছাড়া কাছের মানুষের মৃত্যু মনকে শোকাতুর করে তোলে। ভীতিকর চিত্র বা সংবাদ দেখে আতঙ্কবোধ করা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন; এমন ব্যক্তি যখন দেখেন অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না, তখন তিনি মানসিক চাপ অনুভব করেন।
আরও বলেন, চিকিৎসাসেবার কর্মীরা বাড়তি কাজের চাপের কারণে মানসিক সমস্যায় পড়েন। এ ছাড়া করোনাকালে অর্থনৈতিক সংকট বেড়েছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। এতে মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩০
আপনার মতামত জানানঃ