দাবানল, দাবদাহ, খরা, বন্যা, মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড়ে বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন দেশে এসব দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। চীন, ভারত ও জার্মানিতে চলতি মৌসুমে কয়েক দফা বন্যা, ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র স্মরণকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মুখে পড়েছে। গ্রিস, তুরস্ক, ইতালিসহ দক্ষিণ ইউরোপ পুড়ছে দাবানলে। বেলজিয়ামসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ রেকর্ড বৃষ্টিপাত দেখেছে। ব্রাজিল, মাদাগাস্কারসহ গোটা আফ্রিকা খরায় বিপর্যস্ত। জলবায়ুর এমন চরম বৈরিতার মুখে বিশ্ব।
বর্তমান বিশ্বে ব্যাপকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীতে প্রতি বছর ত্বরিত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে গড় তাপমাত্রার পরিমাণ। সাম্প্রতিক সময়ে অতিমাত্রা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন বিশ্বকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রভাবের কবলে পড়েছে গোটা বিশ্ব।
আশঙ্কার বিষয় হলো, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে ঘন ঘন এসব দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, আগামী দিনগুলোয় এ ধরনের দুর্যোগ আরও বাড়তে পারে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি দশক অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে এমন দুর্যোগের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে বছরে ৫৬০টিতে; যা দৈনিক গড়ে দুটির কাছাকাছি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ দুই দশকে প্রতিবছর ৩৫০ থেকে ৫০০টি মধ্যম থেকে ভয়াবহ দুর্যোগের শিকার হয়েছে বিশ্ববাসী। এটি আগের তিন দশকের গড় দুর্যোগের তুলনায় পাঁচ গুণের বেশি।
জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমনবিষয়ক দপ্তরের (ইউএনডিআরআর) পক্ষ থেকে গত মঙ্গলবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
এক বিবৃতিতে ইউএনডিআরআর বলেছে, বিশ্বজুড়ে দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ার পেছনে বড় একটি কারণ, দুর্যোগের ঝুঁকি সম্পর্কে মানুষের উপলব্ধিগত সমস্যা। অনেক সময় ঝুঁকির বিষয়গুলো ঠিকমতো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অনেকেই মনে করেন, তারা সহজেই দুর্যোগ জয় করতে পারবেন। এমনকি অনেক সময় সাংগঠনিক কিংবা রাষ্ট্রীয় নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও এমন মানসিকতা দেখা যায়। এসব সিদ্ধান্তে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের ঝুঁকির দিকটিতে মনোযোগ না দিয়ে অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় তা অনেক সময় ঝুঁকিতে থাকা মানুষের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়।
চলতি দশক অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে এমন দুর্যোগের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে বছরে ৫৬০টিতে; যা দৈনিক গড়ে দুটির কাছাকাছি।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নিয়ে উপলব্ধিগত সমস্যার কারণে মানুষ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কাজ করে থাকে। এসব কাজ বিশ্বকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলছে। বাড়ছে দুর্যোগের সংখ্যাও। এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির বিষয়গুলো দ্রুত অনুধাবন করতে না পারলে দুর্যোগ ও বিপর্যয় এড়ানো কঠিন হয়ে যেতে পারে।
দুর্যোগের ঝুঁকি নিয়ে এমন আচরণের মাধ্যমে মানুষ নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছে—এমনটাই মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের উপ–মহাসচিব আমিনা মোহাম্মদ।
অন্যদিকে এক বিবৃতিতে ইউএনডিআরআরের প্রধান মামি মিজুতোরি সতর্ক করে বলেন, ‘দুর্যোগের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া বিষয়ে আমাদের প্রকৃত সত্য সবার সামনে বলতে হবে। এটা শুধু প্রয়োজন নয়, অত্যন্ত জরুরি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিষয়টি বেশ স্পষ্ট যে, দুর্যোগের মুখোমুখি হওয়ার আগেই আমাদের তা ঠেকাতে হবে। দুর্যোগের ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না। আগাম প্রতিরোধ কৌশলে ঝুঁকি কমাতে খরচও বেশ কম হবে।’
ইউএনডিআরআরের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত দশকে বিশ্বজুড়ে দুর্যোগ প্রতিরোধ ও ক্ষতি প্রশমনে বছরে প্রায় ১৭ হাজার কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জেরে সংঘটিত দুর্যোগের বেশিরভাগ আঘাত হেনেছে নিম্ন আয়ের দেশগুলোয়। এসব দেশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশেরও কম দুর্যোগ প্রশমনে ব্যয় করে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের ক্ষতির জেরে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৩ কোটি ৭৬ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি হতে পারে বলে সংস্থাটির পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছে।
বর্তমান সময়ে মনুষ্যজনিত গ্রিনহাউজ গ্যাসের ফলে পৃথিবীর উষ্ণায়নকে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অন্যতম কারণ ধরা হয়। যেটি কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধিরতে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ধরা হয়। আর তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সর্বোপরি জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। আর জলবায়ুর এহেন পরিবর্তনের মারাত্মক ঝুঁকিতে বিশ্বের মানুষ।
মানুষের নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য আর দু’দশকের মধ্যেই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা অন্তত দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাচ্ছে। ফলে, তাপপ্রবাহ, শৈত্যপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, ভয়াল বন্যা, খরা, দাবানলের ঘটনা ও তাদের তীব্রতা এতটাই বাড়বে যে তার জন্য বিপন্ন হয়ে পড়বে বিশ্বের প্রায় ৩৬০ কোটি মানুষের জীবন। খাদ্য ও পানির নিরাপত্তার অভাবে সবচেয়ে বিপন্ন হবে মানুষ, বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ-সহ জল ও স্থলের সার্বিক বাস্তুতন্ত্র।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব জুড়ে তাপপ্রবাহ, শৈত্যপ্রবাহ, অতিবৃষ্টি, ভয়াল বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, দাবানলের ঘটনা ও তাদের তীব্রতা বাড়বে। উত্তরোত্তর আরও বেশি এলাকা এই সব প্রাকৃতিক ঘটনার গ্রাসে পড়বে। এমনও নয় যে এখন থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হলে এই অনিবার্যতাকে রোখা যাবে। মানুষের নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে, জীবাশ্ম জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের জন্য যে হারে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন ফিবছর বাড়ছে তাতে এখন হঠাৎ নিয়ন্ত্রণও আর ২০ বছরে পৃথিবীর দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা-বৃদ্ধি রুখতে পারবে না।
ইতিমধ্যেই এই সব প্রাকৃতিক ঘটনার ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে আফ্রিকা, এশিয়া, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, ছোট ছোট দ্বীপ এবং দ্বীপপুঞ্জগুলিতে। আন্টার্কটিকা ও আর্কটিকে। তা আগামী ২০ বছরে আরও প্রকট হয়ে উঠবে। খুবই বেহাল অবস্থা হবে নগরসভ্যতার। নাগরিক জীবনের। খাদ্য ও জলের নিরাপত্তার অভাবে। শহরগুলির মানুষের স্বাস্থ্য, সম্পত্তি, উন্নয়নের পরিকাঠামো, সেই পরিকাঠামোকে চালু রাখার শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থা ও যোগাযোগব্যবস্থার প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হবে জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন এই সব প্রাকৃতিক ঘটনায়।
যে হারে উত্তরোত্তর শহরগুলির উপর জলসংখ্যার চাপ বাড়ছে আর জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে তাতে পরিকল্পনাহীন ভাবনাচিন্তার মাসুল গুনতেই হবে শহরগুলিকে। তার ফলে বেকারি ও দারিদ্র আরও বাড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ফলে প্রাকৃতিক যে বিপর্যয় হবে তার রূপটা হবে ভয়াবহ৷ বিশ্ব এই অবস্থার মুখোমুখি হওয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়৷ বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা যদি ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায় তবে ঝুঁকির পরিমাণও সেই অনুপাতে বাড়বে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব থেকে বিশ্বের কোনো মানুষই রেহাই পাবে না৷
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা সমাধানযোগ্য। আমাদের কাছে প্রযুক্তি আছে। বিজ্ঞান আছে। প্রয়োজন নেতৃত্ব এবং পথ পরিবর্তন করার সাহস। দূষণ রোধ করার জন্য শক্তির সুব্যবহার জরুরি। আমাদের ২০৫০ সালের মধ্যে বা শিগগিরই ‘নিট জিরো’ কার্বন নির্গমকে নিশ্চিত করতে হবে। নিট জিরো মানে— ক্রমান্বয়ে কার্বনের ভারসাম্যে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনা। নিট শূন্য নির্গমন অর্জনের জন্য, আমরা যেভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করি এবং ব্যবহার করি তার ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার।
আমাদের একটি নতুন, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা দরকার। বনভূমি উজাড় বন্ধ করা আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। উডল্যান্ড ট্রাস্ট আগামী ১০ বছরে ৬৪ মিলিয়ন গাছ লাগানোর কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তাকে অনুসরণ করাই হতে পারে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার একটি বিকল্প পথ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১১২১
আপনার মতামত জানানঃ