চার বছর আগে লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টার দায়ে হামলাকারীর যাবজ্জীবন এবং আরও একজনকে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত; চারজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক নুরুল আমীন বিপ্লব মঙ্গলবার(২৬ এপ্রিল) দুপুরে আসামিদের উপস্থিতিতে এ রায় ঘোষণা করেন বলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) মমিনুর রহমান টিটু জানান।
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হলেন ফয়জুল হাসান। আর চার বছরের কারাদণ্ড পেয়েছেন তার বন্ধু সোহাগ মিয়া।
খালাস পেয়েছেন ফয়জুলের বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান, মা মিনারা বেগম, মামা ফজলুল হক ও ভাই এনামুল হাসান।
রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান আসামি ফয়জুল সম্পর্কে বিচারক বলেন, ‘আসামি ফয়জুল হাসান দেশ বা কোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে প্রমাণ হয়নি। সে মুফতি জসিমউদ্দিন রহমানীর (হাফিজাল্লা) বই পড়ে ও বক্তব্য শুনে বিভিন্ন ব্যক্তির প্রতি সংক্ষুব্ধ হয়। অধ্যাপক জাফর ইকবাল বিভিন্ন সময়ে ব্লগার ও নাস্তিকদের পক্ষে কথা বলায় বিশেষত শিশুতোষ গ্রন্থ ‘ভুতের বাচ্চা সুলেমান’ লিখে তিনি নবী সুলায়মান (আ.) কে কটূক্তি করেছেন বলে কাল্পনিক অভিযোগ তুলে তাকে নিজ হাতে হত্যার পরিকল্পা করে ফয়জুল।
‘জাফর ইকবালকে ইসলামের শত্রু ও নাস্তিক আখ্যায়িত করে সে হত্যার চেষ্টা চালায়। ইসলাম ধর্মের প্রকৃত মর্মবাণী না বুঝে নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা পুণ্যের কাজ মনে করে আসামি এই বর্বর হামলা চালিয়েছে। ইন্টারনেট সাইটে জিহাদি আর্টিকেল, জিহাদি বই পড়ে এবং বিভিন্ন উগ্রবাদী বক্তার কথা শুনে সে সন্ত্রাসী কাজে উদ্বুদ্ধ হয়।’
আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনা একটি ‘ধর্মীয় সন্ত্রাস’।
তিনি আরও বলেন, ‘অপর আসামি সোহাগ মিয়া কাপড়ের ব্যবসার আড়ালে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে ফয়জুলকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন জিহাদি বই, অডিও ও ভিডিও ক্লিপ সরবরাহ করে দেশের মুক্তমনা লেখকদের হত্যার ব্যাপারে সলাপরামর্শ করত।’
আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনা একটি ‘ধর্মীয় সন্ত্রাস’।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, স্বাধীন মত প্রকাশ ও পরমতসহিষ্ণুতা, গণতন্ত্র, প্রগতিশীলতার চর্চা না হলে দেশ পেছনের দিকে হাঁটবে। স্বাধীন ও গঠনমূলক ভিন্নমত চর্চার মাধ্যমেই সঠিক পথ পাওয়া সম্ভব।
আদালত বলেন, জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালিয়ে যেসব লেখক মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতিশীলতার পক্ষে থাকেন, তাদের ভয় দেখানোই ছিল আসামি ফয়জুলের মূল উদ্দেশ্য।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক উল্লেখ করেন, ‘ফয়জুলের এহেন কাজ নিঃসন্দেহে একটি সন্ত্রাসী কাজ, আরও স্পষ্ট করে বললে ধর্মীয় সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছু নয়। শুধু ভিন্নমত প্রকাশের জন্য এ দেশে হত্যকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানোর কারণে ভিকটিমের ওপর এহেন কার্য কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এই মামলায় ফয়জুলের বন্ধু সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের উমেদনগর গ্রামের মো. সোহাগ মিয়াকে চার বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া বাকি চার আসামি ফয়জুলের বাবা আতিকুর রহমান, মা মিনারা বেগম, মামা ফয়জুল হক ও ভাই এনামুল হাসানকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি মুমিনুর রহমান এক আসামির যাবজ্জীবন, একজনের চার বছরের কারাদণ্ড ও চারজনের খালাস পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
২০১৮ সালের ৩ মার্চ বিকেলে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে একটি অনুষ্ঠান চলাকালে মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর ছুরি দিয়ে হামলা চালানো হয়। ওই সময় মুহম্মদ জাফর ইকবাল মাথা ও ঘাড়ে আঘাত পান। হামলার ঘটনায় শিক্ষার্থী ও পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ফয়জুল হাসানকে আটক করে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ইশফাকুল হোসেন বাদী হয়ে সিলেট মহানগরের জালালাবাদ থানায় মামলা করেন। এ মামলায় ফয়জুলকে প্রধান আসামি করা হয়। পাশাপাশি ফয়জুলের বন্ধু মো. সোহাগ মিয়া, বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান, মা মিনারা বেগম, মামা ফয়জুল হক ও ভাই এনামুল হাসানকে আসামি করা হয়।
আদালতের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাইনি। পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর আপিল করা হবে কি না, বিষয়টি আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেব।’ রায়ের পর মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গে কথা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি, কথা হয়নি।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মোতাহির আলী বলেন, পুরো রায় না পাওয়া পর্যন্ত মন্তব্য করা যাচ্ছে না। তবে সাজাপ্রাপ্ত দুজন আসামি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০১৭
আপনার মতামত জানানঃ