সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের মতপ্রকাশের কারণে ব্লগার ও লেখক দিপু কুমারকে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন গতকাল বৃহস্পতিবার এই রায় দেন।
মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, দিপু কুমারের বিরুদ্ধে ফেসবুকে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়। ২০২০ সালের ২৪ এপ্রিল সাইবার ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে মামলাটি হয়।
পরে মামলাটি এজাহার হিসেবে রেকর্ড করতে শাহজাহানপুর থানাকে নির্দেশ দেন আদালত। পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে ২০২১ সালের ৯ মে দিপু কুমারের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়।
অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ওই বছরের ৫ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এ মামলায় দিপু কুমার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
দিপু ফেসবুক পেজ ‘দিয়ার্ষি আরাগ’ ব্যবহার করে দর্শন, ধর্ম, সংস্কৃতিসহ দেশি-বিদেশী বিভিন্ন বিষয়ে নিজের বক্তব্য রাখতেন। এছাড়াও, তিনি তার এমন বক্তব্যসমূহ বই আকারে প্রকাশ করেন। যা পরবর্তী সময়ে হাইকোর্ট কর্তৃক নিষিদ্ধ করা হয়। এ ঘটনায় গত ০৩ মার্চ ২০২০ তারিখে দৈনিক আল-ইহসান পত্রিকার সাংবাদিক মুহম্মদ আরিফুর রহমান তার বিরুদ্ধে রাজধানীর শাহজাহানপুর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ধর্মীয় ও ব্যক্তি স্বাধীনতায় আঘাতের অভিযোগে দিপু কুমার ওরফে শাহারিয়ার দিপুর ‘দিয়া আরেফিন’ এবং ‘নানীর বানী’ নামে দুটি বইয়ের প্রকাশ, বিক্রয়, বিতরণ ও বিপণন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট।
এছাড়া, আদালতের এই আদেশ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসককে ও নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো।
তাকে (দিপুকে) ঢাকা মোট্রেপলিটন পুলিশের সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ ২০২০ সালের ২২ নভেম্বর ডেকে নিয়ে যায়। দুইদিন দিন জিজ্ঞাসাবাদ করার পর শাহজাহানপুর থানায় হস্তান্তর করা হয়। আমরা বিষয়টি পরে জেনেছি। আদালতে বারবার জামিন চেয়েছি জামিন দেওয়া হয়নি।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মোট্রেপলিটন পুলিশের সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ ২০২০ সালের ২৩ নভেম্বর অভিযান চালিয়ে যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেপ্তার করে।
লেখক ও ব্লগার দিপু কুমার বর্তমানে কারাগারে আছেন।
দিপু কুমারের বোনের ছেলে সঞ্জয় কুমার ভদ্র বলেন, ‘তাকে (দিপুকে) ঢাকা মোট্রেপলিটন পুলিশের সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ ২০২০ সালের ২২ নভেম্বর ডেকে নিয়ে যায়। দুইদিন দিন জিজ্ঞাসাবাদ করার পর শাহজাহানপুর থানায় হস্তান্তর করা হয়। আমরা বিষয়টি পরে জেনেছি। আদালতে বারবার জামিন চেয়েছি জামিন দেওয়া হয়নি।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সঞ্জয় কুমার ভদ্র বলেন, ‘রায়ে আমরা সংক্ষুদ্ধ। রায়ের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে উচ্চ আদালতে যাবো। ’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট স্বাধীনভাবে মত প্রকাশে বড় বাধা। আইনটি মুক্তমনাদের বিরুদ্ধে, এটি তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের একটি বিচার বিভাগ। অন্য দুটি হলো নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা বা সংসদ। একটি ভালো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তা-ই, যেখানে তিনটি বিভাগই সর্বোচ্চ দক্ষতার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে এবং থাকবে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। নির্বাহী বিভাগ, সংসদ ও বিচার বিভাগের বাইরে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ রয়েছে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দিতে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা অস্বীকার করে না কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
মতামত প্রকাশের অধিকার গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কারণ এটি জনগণকে তথ্য ও ধারণার অবাধ প্রবাহের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিতে সক্ষম করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যক্তিগত বিকাশের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এটি আমাদের মতবিরোধ এবং শোনার অধিকার দেয়। বিভিন্ন চিন্তাভাবনা এবং মতামত প্রকাশের দ্বারা আমরা আমাদের মৌলিক বিশ্বাস সম্পর্কে নিজস্ব পছন্দ পোষণ করতে পারি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে কালো আইনের মাধ্যমে সরকার তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চায়। কেউ যেন এই সরকারের নানা দুর্নীতি অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারে, সেই জন্যই এই সরকার ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট তৈরি করে মানুষের মুখ বন্ধ রাখতে চায়।
তারা বলেন, আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা— এটা সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। যে অধিকার আইন করেও খর্ব করা যায় না। দুর্ভাগ্যবশত আজকে স্বাধীনতার সুর্বণ জয়ন্তী উদযাপন করার পরও আমরা এই স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছি।
তারা বলেন, স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার যেখানে স্বীকৃত, সেখানে তার অপব্যবহার হতেও পারে। তবু সেই অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের কথা স্মরণ করতে পারি: ‘জনগণের ইচ্ছাই যেকোনো সরকারের একমাত্র বৈধ ভিত্তি; আর আমাদের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ