
রাজধানীর কলাবাগানে তেঁতুলতলা মাঠ সংরক্ষণ করাসহ মাঠ রক্ষার আন্দোলনকর্মী সৈয়দা রত্না ও তার ছেলে ঈসা আব্দুল্লাহকে পুলিশি হয়রানির নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে অধিকারকর্মীরা।
রাজধানীর কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার আন্দোলনকর্মী সৈয়দা রত্নাকে ১৩ ঘণ্টা আটকে রাখার ঘটনার সমালোচনা করেছেন অধিকারকর্মীরা। অভিযোগ ছাড়া নাগরিককে তুলে নিয়ে যাওয়া কেন, সরকারি কাজে বাধা দেওয়া কী, অভিযোগ ছাড়া এক নারীকে তুলে নেওয়া, গণতান্ত্রিক দেশে আন্দোলন না করার মুচলেকা কেন—এসব প্রশ্ন তুলেছেন তারা। তেঁতুলতলা মাঠে থানা না বানানোর দাবি জানিয়ে তারা রত্নাকে আটকের বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান।
সোমবার(২৫ এপ্রিল) রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘তেঁতুলতলা মাঠে থানা না এলাকাবাসীকে হয়রানি ও আটকের তীব্র প্রতিবাদ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে অধিকারকর্মীরা এসব প্রশ্ন তুলেন ও ঘটনার তীব্র সমালোচনা করেন।
সংবাদ সম্মেলনের আয়োজক ছিল এএলআরডি, বাপা, বেলা, আসক, ব্লাস্ট, গ্রীন ভয়েস, নিজেরা করি, নাগরিক উদ্যোগ, নারীপক্ষ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি ও টিআইবি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৭নং ওয়ার্ডে পান্থপথের উল্টো দিকের গলির পাশের খোলা জায়গাটিই তেঁতুলতলা মাঠ হিসেবে পরিচিত। স্থানীয় শিশুরা সেখানে খেলাধুলা করে। মাঠটিতে ঈদের নামাজ, জানাজাসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান হয়। গত ৩১ জানুয়ারি কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠে খেলতে যাওয়া কয়েকজন শিশুকে কান ধরে ওঠবস করায় পুলিশ। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তিন পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়।
সম্প্রতি মাঠটিতে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বেষ্টনি তৈরি করে সেখানে জনসাধারণের প্রবেশ বন্ধ করেছে কলাবাগান থানা কর্তৃপক্ষ। সেখানে টানিয়ে দেওয়া সাইনবোর্ডে মাঠটিতে কলাবাগান থানা ভবণ নির্মাণের কথা জানানো হয়েছে।
এরপরই তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষায় এলাকাবাসী ধারাবাহিকভাবে মানববন্ধনসহ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আয়োজন করে চলেছে।
অন্যদিকে স্থানীয় এলাকাবাসী, নাগরিক সমাজ, পরিবেশবাদী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের আপত্তি ও দাবি উপেক্ষা করে কলাবাগান থানা কর্তৃপক্ষ মাঠটিতে ইট, বালু, সিমেন্ট ও সুরকি এনে স্তুপ করে রেখে সাধারণের প্রবেশ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছে।
গতকাল মাঠ রক্ষায় বিভিন্ন সময়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার সময় আন্দোলনকারীদের সংগঠক সৈয়দা রত্না ও তার ১৭ বছর বয়সী ছেলে ঈশা আব্দুল্লাহকে কলাবাগান থানা কর্তৃপক্ষ আটক করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন মহল থেকে নিন্দার ঝড় ওঠে। পরে বিক্ষোভের মুখে মাঝরাতে তাদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এ মাঠ রক্ষায় এবং রত্নাকে বিনা অভিযোগ আটক রাখার প্রতিবাদ জানিয়েছে একাধিক সংগঠন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গতকাল দিনভর কলাবাগান থানা কর্মকর্তাদের মুঠোফোন বন্ধ ছিল। কেউ কোনো উত্তর দিচ্ছিলেন না। যারা থানায় খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন, তাদের প্রথম ঢুকতে বাধা দেওয়া হয় বলেও জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে গেলে এখন হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। বসবাসের অযোগ্যের তালিকায় থাকা শহরে একটা খেলার মাঠ নিয়ে নেওয়া মানে আত্মহত্যার শামিল। এলাকাবাসী খেলবে কোথায়, এই জবাব কি কর্তৃপক্ষ দেবে?
আমরা বলি গণতন্ত্র, আবার বলি মাঠ রক্ষার আন্দোলন করা যাবে না। তাহলে কী নিয়ে আন্দোলন করা যাবে, তার একটা তালিকা দিয়ে দেওয়া হোক। সরকারি কাজের তালিকা দেওয়া হোক।’
রত্নাকে আটকের ঘটনা প্রসঙ্গে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা আবার দেখলাম। তিনি যদি কোনো আইন ভঙ্গ করতেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া যেত। কিন্তু পুলিশ চাইলে তার গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতে পারে এবং তার ছেলেকেও তুলে নিয়ে গেল।’
গতকালের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি এবং দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, তারা আইনি ব্যবস্থা নেবেন। এ ছাড়া বলেন, ‘মুচলেকার ভাষা হচ্ছে মাঠ রক্ষার আন্দোলন করা যাবে না। আমরা বলি গণতন্ত্র, আবার বলি মাঠ রক্ষার আন্দোলন করা যাবে না। তাহলে কী নিয়ে আন্দোলন করা যাবে, তার একটা তালিকা দিয়ে দেওয়া হোক। সরকারি কাজের তালিকা দেওয়া হোক।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুজন নাগরিককে আটকে রাখা যায়। কিন্তু এ দেশে ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি কোনো দিন হবে না? বলবে না তারা লজ্জিত বা দুঃখিত। সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে আটক করে একটি মুচলেকা দিয়ে ছাড়া হয়েছে। এটি পরিকল্পিত। এলাকার অন্যদের ভয় দেখানোর জন্য।’
নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির বলেন, ‘এটা কি মগের মুল্লুক নাকি যে চেনা মুখ হলেই রেহাই পাওয়া যেতে পারে? এই দেশে সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার নাই? আইন কি নিজের মতো চলে না?’
রত্নাকে ছেড়ে দেওয়ার পরও সংবাদ সম্মেলন করার কারণ হিসেবে খুশী কবির বলেন, মানুষ প্রশ্ন করবে, জবাব চাইবে। নাগরিককের কী অধিকার, সুরক্ষার জন্য কী ব্যবস্থা—এসব কথা বলতে হবে।
জনগণের বন্ধু বলা হয় পুলিশকে। তারা যদি বন্ধুই হয়ে থাকে, তাহলে তারাই সবার আগে মাঠ রক্ষায় এগিয়ে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন। শহরের মাঠ দখল হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ধানমন্ডির শেখ জামাল মাঠটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু সেখানে সাধারণ মানুষ ঢুকতে পারে না। সেখানে পুলিশ কোথায়, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, তেঁতুলতলা মাঠটি সংরক্ষণ করতে হবে এবং থানা নির্মাণের কাজ দ্রুত বন্ধ করতে হবে। মাঠটি রক্ষায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও রাজউককে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। পাশাপাশি সৈয়দা রত্না, তার পরিবার এবং আন্দোলনে যুক্ত এলাকাবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
এ ছাড়া তিনি বলেন, গতকালের ঘটনায় ১০টি আইনের লঙ্ঘন হয়েছে। শিশু অধিকার রক্ষার কথা বলায় মাকে জেলে দিতে হবে? এই অবিচারের বিচারের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানান। তেঁতুলতলা মাঠ থেকে দ্রুত কাঁটাতারের বেড়া সরানোর দাবি জানিয়ে বলেন, প্রতিশ্রুতি না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
এদিকে এবার ঈদের জামাত কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠে আদায় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এলাকাবাসী। এটি সহ আরো ৫টি দাবি জানিয়েছেন তারা।
সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে তেঁতুলতলা মাঠে নাগরিক প্রতিবাদ সমাবেশে এলাকাবাসীর পক্ষে এসব দাবি তুলেন স্থপতি ইকবাল হাবীব।
তিনি বলেন, ‘আজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন— খুব শিগগিরই এখান থেকে থানা নির্মাণ স্থানান্তর করা হবে৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই আশ্বাসের পরও যদি কেউ ঈদুল ফিতরের বন্ধে মাঠে কোনো সীমানা দেয়াল নির্মাণ করতে চায়, তবে এলাকার সবাই প্রতিবাদ গড়ে তুলবে।’
সমাবেশে ৫ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হলো—
১. স্থানীয়রাই দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও রাজউককে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে এই মাঠ তারা কেমন করে ব্যবস্থাপনা করবে।
২. বিকল্প জায়গায় থানা করতে হবে। এই জায়গায় থানা হবে না।
৩. এই মাঠটাতে আবারও আগের মতো ঈদের জামাত করার জন্য প্রস্তুত করতে হবে।
৪. বেআইনিভাবে রত্মা ও তার ছেলেকে আটক রাখার নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে। যাতে সরকারি কাজের নামে নগরিকদের অধিকারের ওপর আর কেউ হস্তক্ষেপ করতে না পারে।
৫. এলাকাবাসীকে হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখানো যাবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩৭
আপনার মতামত জানানঃ