এত বড় সৌরমণ্ডল, এত গ্রহ, তারা। সেখানে পৃথিবীতেই কেবল প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে, একথা ভাবতে মন চায় না মানুষের। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, প্রাণ আছে অন্যত্রও। ফলে দিন-রাত এক করে অজ্ঞাত ‘প্রতিবেশী’র খোঁজ চলছে।
বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপা ঘিরে যেন বিজ্ঞানীদের বিস্ময়ের শেষ নেই। এ চাঁদে পানি থাকতে পারে বলে আগে থেকেই বলে আসছেন গবেষকেরা। এখন তারা বলছেন, বৃহস্পতিতে থাকা শৈলশিলার নিচে জলের অগভীর পকেট রয়েছে। নতুন এ গবেষণার ফল তাদের ভিনগ্রহের প্রাণী খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে আশা বৃদ্ধি করছে। খবর এএফপির।
সৌরজগতের পঞ্চম গ্রহ বৃহস্পতির অবস্থান মঙ্গলের পরেই। এখন পর্যন্ত বৃহস্পতির ৭৯টি চাঁদের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে ইউরোপা একটি। এর ভূগর্ভস্থ মহাসাগরের উৎপত্তির রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন বিজ্ঞানীরা। এরপরই তারা বৃহস্পতির এই চাঁদ নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন।
গবেষকেরা বলেন, ইউরোপায় বিশাল সমুদ্র রয়েছে। এ কারণে সেখানে কোনো ধরনের জীবনের রূপ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে জীবনের জন্য মূল উপাদান পানির অস্তিত্বই একে জীবনধারণের উপযোগী করে তুলতে পারে। তবে এত দিন ধারণা করা হতো, এই চাঁদের পানির অস্তিত্ব রয়েছে ইউরোপের পৃষ্ঠের অনেক গভীরে। তা ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত গভীর হতে পারে। এই পানির ওপরে রয়েছে কঠিন বরফের স্তর। কিন্তু এখন গবেষকেরা বলছেন, ইউরোপায় পানির খোঁজ মিলতে পারে আরও কাছাকাছি।
গবেষণাসংক্রান্ত নিবন্ধ নেচার কমিউনিকেশনস সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে গবেষকেরা বলেছেন, আকস্মিকভাবেই তারা বিষয়টি ধরতে পারেন। গ্রিনল্যান্ডের বরফের স্তর নিয়ে গবেষণার সময় তারা ইউরোপা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। তখন তারা পরিচিত একটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেন।
গবেষকেরা গ্রিনল্যান্ডের এম-আকৃতির বরফের চূড়াগুলোর সঙ্গে ইউরোপার মিল খুঁজে পান। ১৯৯০ সালে নাসার গ্যালিলিও মহাকাশযান ইউরোপার ছবি তুলেছিল। কিন্তু সেখানকার এসব শৈলশিলা কীভাবে গঠিত হয়েছিল, সে সম্পর্কে খুব কমই জানা ছিল।
বিজ্ঞানীরা বরফভেদকারী রাডার ব্যবহার করে দেখেন, গ্রিনল্যান্ডের শিলাগুলোর ৩০ মিটার নিচে পানি জমা হয় এবং তা ভেঙে যায়। এ থেকেই বরফের খাঁজ তৈরি হয়। একই বৈশিষ্ট্য ইউরোপাতেও থাকতে পারে।
নাসার পক্ষ থেকে ২০২৪ ও ২০৩০ সালে ইউরোপা ক্লিপার মিশন নামে দুটি মিশন পরিচালনা করা হবে, যাতে বিশেষ রাডারের সাহায্যে এই চাঁদের পানি ও সমুদ্রের অনুসন্ধান করা হবে।
এর ভূগর্ভস্থ মহাসাগরের উৎপত্তির রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন বিজ্ঞানীরা। এরপরই তারা বৃহস্পতির এই চাঁদ নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন।
ইউরোপায় পানি রয়েছে। এমনকী পৃথিবীর মহাসাগরগুলিতে যত পানি আছে, তার চেয়ে বেশি পানি রয়েছে ইউরোপার বিরাট অতলান্ত মহাসাগরে। প্রাণের আর একটি প্রধান উপাদান অক্সিজেনও রয়েছে ইউরোপার বরফে মোড়া পিঠে। যাকে টেনে বরফের নীচে নিয়ে গিয়ে তরল পানির মহাসাগরে মেশাচ্ছে ইউরোপাই। তার অভিনব প্রক্রিয়ায়। সবটা মিলিয়ে প্রাণ সৃষ্টি ও তার বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে বলেই মনে করছেন গবেষকরা।
মহাসাগরগুলো রয়েছে ইউরোপার বরফের নিচে। প্রাণের সৃষ্টি ও বিকাশের জন্য যে রাসায়নিক উপাদানগুলোর প্রয়োজন বেশি, তাও রয়েছে ইউরোপার মহাসাগরে। সেখানে অক্সিজেনও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন বরফের নিচে নিয়ে গিয়ে মিশছে পানির মহাসাগরে। উপরে জমা অক্সিজেনের ৮৬ শতাংশই পৌঁছে যাচ্ছে মহাসাগরগুলোতে।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক মার্ক হেসির নেতৃত্বে চালানো এক গবেষণায় জানা গেছে, চাঁদের টানে যেমন পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটা হয় তেমনই আকারে খুব বড় ও ভারী গ্রহ বৃহস্পতির অত্যন্ত জোরালো অভিকর্ষ বলের টানই ইউরোপায় প্রাণকে টিকে থাকার প্রয়োজনীয় শক্তি জোগাতে পারে। সেই টানই পুরু বরফে মোড়া ইউরোপার অন্দরকে উষ্ণ থাকতে সাহায্য করে। এজন্য বরফে মোড়ানো থাকলেও ইউরোপার মহাসাগরগুলোর পানি কনকনে ঠান্ডায় জমে বরফে পরিণত হয় না।
পৃথিবী ছাড়াও সৌর জগতের আর কোথাও বসতি গড়া সম্ভব কি না, তা নিয়ে বিস্তর জল্পনা কল্পনা চলে বিজ্ঞানীদের মধ্যে। আর এ তালিকাতে নতুন করে যোগ দিয়েছে বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপা। আকারে এই উপগ্রহটি চাঁদের থেকে সামান্য একটু ছোট। কিন্তু প্রাণ সঞ্চারের প্রাথমিক শর্ত যেটি, সেই পানি নাকি রয়েছে ওই উপগ্রহে। রয়েছে একটা আস্ত সমুদ্র। বিজ্ঞানীরা অন্তত তেমনই দাবি করছেন। তাই তাদের মনে হচ্ছে, সেই উপগ্রহে থাকলেও থাকতে পারে প্রাণের সন্ধান। আর যদি নাও থাকে, তাহলে এখানে বসতি গড়ে তুলতে পারে মানুষ।
পৃথিবীর বাইরে মহাবিশ্বে প্রাণের অনুকূল, এমন গ্রহের সন্ধান চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। সেই তালিকায় মঙ্গল, শনির উপগ্রহ এনসেলাডাস-এর নাম রয়েছে। সেই তালিকাতে এবার ইউরোপাও ঢুকে পড়ল। নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন, যখন সমুদ্রটি তৈরি হয়েছিল, তখন এটি নিশ্চিতভাবে বসবাসের যোগ্যই ছিল। তবে ইউরোপার পানিতে নাকি কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেশি। তাই যে সমস্ত জীবের পক্ষে কার্বন ডাই অক্সাইডের সাহায্যে জীবন ধারণ করা সম্ভব, তারা এখানে থাকলেও থাকতে পারে। তাহলে কি সেখানে সবুজ উদ্ভিদ রয়েছে? যদি থাকে, তাহলে তো সেখান থেকেই অক্সিজেনের মাত্রাও বাতাসে বাড়তে পারে। আর তৈরি ভারসাম্যে মানুষের বসতি গড়া খুব একটা কঠিন কাজ নয়।
কিন্তু মানব সভ্যতা সেখানে তৈরি হবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে এখনও অনেকটাই দেরি রয়েছে। কারণ, মানুষের বসবাসের অনুকূল পরিবেশ তৈরি আছে কি না তা বুঝতে শুধু পানির উপস্থিতি না, আরও অনেকগুলি জিনিস বুঝতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪৪
আপনার মতামত জানানঃ