পৃথিবীজুড়ে নতুন নতুন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব হচ্ছে। এর মধ্যে যেমন রয়েছে নতুন আবির্ভাব হওয়া রোগজীবাণু ও ভাইরাস, তেমনি রয়েছে নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে পুরোনো রোগের ফিরে আসা। যেমন কোনো একটি রোগ হয়তো আগে বেশি বয়স্ক ব্যক্তিদের হতো, সেটা এখন তরুণ-যুবকদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে, প্রচলিত চিকিৎসার বিরুদ্ধে রোগটির প্রতিরোধক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছে, রোগীর সংখ্যা ও রোগের বিস্তার আগের চেয়ে বেড়েছে অত্যন্ত দ্রুত।
মহামারি করোনা নিয়ে আতঙ্ক কমছে ধীরে ধীরে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যাও দিনদিন কমছে। করোনা নিয়ে আতঙ্ক কমলেও বাড়ছে মানুষের জীবন ও জীবিকা নিয়ে। এরইমধ্যে দেশজুড়ে পুরনো মহামারিগুলো নতুন করে আভির্ভূত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানেই ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ছে, বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। কোথাওবা হাসপাতালে দেখা দিয়েছে বেডের সংকট। এমতাবস্থায় মানুষ পড়েছে চতুর্মুখী বিপর্যয়ে।
হঠাৎ করে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় গরমের সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বেড়েছে পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা। ঢাকার আশপাশের জেলাতেও ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। ডায়রিয়া রোগী কমার কোনো আভাস নেই। চলতি বছর হঠাৎ করেই রাজধানীসহ সারাদেশে এর সংক্রমণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, স্বাস্থ্য বিভাগ কলেরার মুখে খাওয়ার টিকা বিতরণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
ডায়রিয়ার পাশাপাশি আবারও ফিরে এসেছে চিকেন পক্স বা জলবসন্ত, হিট স্ট্রোক, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুসহ কয়েকটি পুরোনো সংক্রামক রোগ। স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষকে এখন করোনাভাইরাসের পাশাপাশি এসব রোগ মোকাবিলারও প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে।
জাতীয় দৈনিক সমকালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সারাদেশে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ করে। ওই তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত একক রোগ হিসেবে শীর্ষে অবস্থান করছে ডায়ারিয়া। এই সময় সারাদেশে চার লাখ ৬১ হাজার ৬১১ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের একজন কক্সবাজার এবং অন্যজন লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা। এ ছাড়া রাজধানীর ২৫ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসার পথেই মারা গেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন আইসিডিডিআর,বির এক কর্মকর্তা।
ডায়রিয়া আক্রান্ত শীর্ষ অঞ্চল ঢাকা বিভাগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন এক লাখ ৫৯ হাজার ২৪৭ জন। এর পর আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন পর্যায়ক্রমে খুলনায় এক লাখ এক হাজার ৮১৯ জন, চট্টগ্রামে ৫১ হাজার ৫৯৬ জন, রাজশাহীতে ৩৭ হাজার ৬০৩ জন, রংপুরে ৩৪ হাজার ৮১৯ জন, সিলেট বিভাগে ৩২ হাজার ৯৩৮ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩২ হাজার ১৮৬ জন এবং বরিশালে ১১ হাজার ৪০৩ জন।
ডায়রিয়ার চলমান প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই আতঙ্ক বাড়াচ্ছে এডিস মশা। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিচালিত এক জরিপে রাজধানীর চার দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভার অস্তিত্ব মিলেছে, যা গত বছরের চেয়ে এক শতাংশ বেশি। গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। তাদের মধ্যে মারা যান ১০৫ জন। চলতি বছর এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৭৭ জন। তবে এখনও কারও মৃত্যু হয়নি। তবে এখনই সতর্ক না হলে চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ডায়রিয়ার পাশাপাশি আবারও ফিরে এসেছে চিকেন পক্স বা জলবসন্ত, হিট স্ট্রোক, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুসহ কয়েকটি পুরোনো সংক্রামক রোগ। স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষকে এখন করোনাভাইরাসের পাশাপাশি এসব রোগ মোকাবিলারও প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে।
দেশের পার্বত্য তিনটিসহ ১৩ জেলায় কয়েক বছর ধরে নিয়ন্ত্রণে থাকা ম্যালেরিয়ার বিস্তার সম্প্রতি ঊর্ধ্বমুখী। গত বছর ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ছয় হাজার ১৩০ জন, মারা গেছেন ৯ জন। চলতি বছর ম্যালেরিয়ায় এ পর্যন্ত ৬০১ জন আক্রান্ত এবং একজন মারা গেছেন। সামনে বর্ষা মৌসুমে ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি নাজুক হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. একরামুল হক বলেন, দেশের ১৩ জেলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপের কথা বলা হলেও রোগী বেশি মূলত পার্বত্য তিন জেলায়। কয়েকটি জেলায় এটির সংক্রমণ ঘটেছে সংক্রমিত এলাকা থেকে। বর্তমানে কয়েকটি জেলাকে ম্যালেরিয়ামুক্তও ঘোষণা করা যায়। তবে পার্বত্য তিন জেলার ওপর নজর রাখতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ জন্য কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে।
এদিকে হঠাৎ করেই বেড়েছে নিয়ন্ত্রণে থাকা চিকেন পক্স বা জলবসন্তও। গত দেড় থেকে দুই মাস ধরে শিশুদের পাশাপাশি বয়স্করাও এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রতি বছর বসন্ত ঋতু আগমনের সঙ্গে সঙ্গে জলবসন্তের সংক্রমণ ঘটে। তথ্য-উপাত্ত না থাকলেও চিকিৎসকরা বলেছেন, আগের তুলনায় জলবসন্ত বা চিকেন পক্সে আক্রান্ত রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জলবসন্তের রোগী গত বছরের তুলনায় এবার কিছুটা বেশি। সংক্রামক রোগ হওয়ায় অন্যান্য রোগীর সঙ্গে জলবসন্তের রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব হয় না। এ কারণে তাদের সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে শিশু রোগীদের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই জলবসন্তে আক্রান্ত রোগীর নিউমোনিয়া হলে তাকে হাসপাতালে আইসোলেশনে রেখে দেওয়া হয়। এ ধরনের কিছু রোগী তাদের হাসপাতালেও ভর্তি করা হয়েছে।
তীব্র গরমে শরীরের তাপমাত্রা বাড়লে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক সময় এতে রোগীর মৃত্যু হয়। মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট, যা ১০৪ ডিগ্রির বেশি হলে শরীরের রক্তচাপ কমে যায়। মস্তিস্কের যে অংশটি শরীরের তাপমাত্রা নিযন্ত্রণ করে, তীব্র তাপমাত্রার কারণে সেটি শরীরের ওপর নিযন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তখন মানুষ অচেতন হয়ে পড়তে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এ অবস্থাকে ‘হিট স্ট্রোক’ বলা হয়। গত বছর মে মাসে তীব্র গরমে শিমুলিয়া ফেরিঘাটে হিট স্ট্রোকে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছিল।
মানুষ-প্রাণীর ক্রমবর্ধমান ঘনত্ব ও ঘনিষ্ঠতা, পরিবেশের প্রতিরক্ষাসক্ষমতা ক্রমবর্ধমান হারে ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া প্রভৃতি কারণে প্রাণী ও প্রকৃতি থেকে নতুন নতুন রোগজীবাণু বা ভাইরাস মানবদেহে ঢুকছে। জলবায়ু পরিবর্তন ঘুমিয়ে যাওয়া জীবাণুকে জাগিয়ে দিচ্ছে, এক ঋতুর রোগ অন্য ঋতুতে নিয়ে যাচ্ছে বা ঋতুর সীমা অতিক্রম করে সারা বছরই রোগ থাকছে। মানুষের জীবনধারার পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, খাদ্য ও অন্যান্য সম্পদের অপচয়, কীটপতঙ্গবাহিত রোগ ও প্রতিরোধযোগ্য অসংক্রামক ব্যাধিরও (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যানসার, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসরোগ ইত্যাদি) বিস্তার ঘটাচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করে দেখেছেন, মানুষের মধ্যে প্রতি ১০টি সংক্রামক ব্যাধির মধ্যে ৬টির বেশি রোগ প্রাণীর কাছ থেকে ছড়াচ্ছে। আর প্রতি ৪টি নতুন সংক্রামক রোগের মধ্যে ৩টিই প্রাণীবাহিত। আমাদের জানা যেসব রোগ প্রাণীর কাছ থেকে মানুষের কাছে ছড়াচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে নিপাহ, তড়কা (অ্যানথ্রাক্স), এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, মার্স করোনা ভাইরাস, প্যানডেমিক ইনফ্লুয়েঞ্জা, জলাতঙ্ক (র্যাবিস), লেপ্টোস্পাইরোসিস, ইবোলা, মারবার্গ প্রভৃতি। কীটপতঙ্গবাহিত রোগের মধ্যে রয়েছে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, পীতজ্বর (ইয়েলো ফিভার), ওয়েস্ট নাইল ফিভার প্রভৃতি।
বাংলাদশে এই রোগগুলোর বেশ কয়েকটি উপস্থিতি রয়েছে। পুরোনো যেসব রোগ বাংলাদেশ বা পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে একেবারেই কমে গিয়েছিল, যা আবার নতুন করে দেখা দিচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে কলেরা, ম্যালেরিয়া।
এসব বিষয়ে করণীয় হিসাবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা বাড়ানো, জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমেই আমরা দ্রুত এসব অপ্রচলিত গুরুতর রোগব্যাধি শনাক্ত করতে পারি। আমাদের দেশে কতগুলো নির্দিষ্ট সংক্রামক রোগের নজরদারির ব্যবস্থা চালু আছে। হঠাৎ করে নতুন ও অজানা রোগের নজরদারির জন্য ঘটনাভিত্তিক নজরদারি ব্যবস্থাও চালু আছে। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠান এর দায়িত্বপ্রাপ্ত, সেটি সিংহভাগ বৈদেশিক সহায়তানির্ভর। প্রয়োজন দেশের রাজস্ব বাজেটের ওপর ভিত্তি করে দেশের নজরদারির ব্যবস্থা শক্তিশালী করা। কারণ, রোগ নজরদারির ব্যবস্থা দেশের স্বাস্থ্যনিরাপত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। সারা বিশ্ব আজ স্বাস্থ্য নিরাপত্তা গড়ে তুলতে কাজ করছে। আমরা কি আমাদের স্বাস্থ্যনিরাপত্তা শক্তিশালী করতে কাজ করব না?
তারা বলেন, দেশের জনস্বাস্থ্যের ব্যবস্থা, রোগ নজরদারির ব্যবস্থা, জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি সাড়াদানের ব্যবস্থা, চিকিৎসাব্যবস্থা ও ল্যাবরেটরি সক্ষমতাকে যথাযথভাবে প্রস্তুত রেখে নতুন রোগ ও নতুন করে আবির্ভাব হওয়া রোগগুলোর উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা করা যায়। আর আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব, বিশেষ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক রেখে এ ধরনের জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলার সুযোগ রাখতে হবে। রোগ প্রাদুর্ভাবের তথ্য গোপন রেখে দেশের ভেতরে ও বাইরে জনগণ ও উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানের কার্যকর সহযোগিতা পাওয়া সম্ভব নয়। একটি পেশাদার ঝুঁকি সংযোগ (রিস্ক কমিউনিকেশন) সংস্কৃতি গড়ে তুলেই তা করা সম্ভব।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম সমকালকে বলেন, গত দুই বছর করোনা মোকাবিলা করতে গিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এদিকে বিশ্বের কয়েকটি দেশে নতুন করে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। সুতরাং বাংলাদেশেও এটি আবারও ছড়াতে পারে। তাই করোনা মোকাবিলার প্রস্তুতি রাখতে হবে। একই সঙ্গে ডায়রিয়ার সংক্রমণ শুরু হলে তা প্রতিরোধের পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া নিয়েও উদ্বেগ আছে। সরকারি হাসপাতাল ও সংশ্নিষ্ট শাখাগুলোকে এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২২
আপনার মতামত জানানঃ