তিমি, ডলফিন, হাঙ্গর ও শাপলাপাতা (স্টিং-রে)সহ সামুদ্রিক মাছের নয়টি গণ এবং ৫২ টি প্রজাতি শিকার বাংলাদেশে আইনত নিষিদ্ধ হলেও বঙ্গোপসাগরে অবাধে চলছে হাঙ্গর শিকার। শিকার নিষিদ্ধ এ প্রানীটির তাজা মাংশ ও শুটকি কেনাবেচা-মজুদ হচ্ছে প্রকাশ্যেই।
শিকার করা হাঙ্গরের জায়গা হয় মৎস সমবায় সমিতি মার্কেটের বিভিন্ন আড়তের ফ্রিজে। হাঙ্গরগুলো যেখানে নামানো হচ্ছিলো, তার ঠিক ২০ গজের মধ্যেই কোতোয়ালী থানার পাথরঘাটা পুলিশ ফাঁড়ির অবস্থান। পুলিশের কোন প্রতিক্রিয়া নেই।
এমনকি হাঙর ও রে মাছের পাখনা, ফুলকা প্লেট তরুণাস্থি, লিভার, লিভারের তেল চট্টগ্রাম থেকে মায়ানমার হয়ে পাচার হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ট্রাফিক’র একটি জরিপ অনুযায়ি, নিষিদ্ধ হলেও হাঙ্গর রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে ২০তম। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, অবাধ শিকারের কারণে বঙ্গোপসাগরে মাছের পরিমাণ কমছে।
বাংলাদেশের জলসীমা থেকে এ পর্যন্ত ২২টি পরিবারের অন্তর্গত মোট ৪৬ প্রজাতির হাঙর ও ৫৮ প্রজাতির শাপলাপাতা মাছ রেকর্ড করা হয়েছে। সামুদ্রিক প্রাণীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী হাঙ্গর ও শাপলাপাতার ৩৬ শতাংশ বিলুপ্তির ঝুঁকি রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক আলিফা বিনতে হক বলেন, প্রায় ৭০ হাজার জাহাজ প্রতিদিন বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ শিকার করছে। তাই একটি জালে যদি একটি হাঙ্গরও ধরা পরে তাহরে সেই সংখ্যা ৭০ হাজার।
“কক্সবাজারের দিকে কয়েক বছর আগে ছয়-সাতটা ট্রলার ছিলো যারা বড়শি দিয়ে টার্গেট করে হাঙ্গর শিকার করতো। কিন্তু এখন সে সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে।”
বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে (২০১২) তিমি, ডলফিন, হাঙ্গর ও স্টিং-রেসহ সামুদ্রিক মাছের সুরক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বন অধিদপ্তরকে।
অধিদপ্তরের প্রধান মোল্লা রেজাউল করিম বলেন, বণ্যপ্রাণী আইন অমান্য করে বাংলাদেশে হাঙ্গর শিকার বহুদিন ধরেই হচ্ছে। সংঘবদ্ধভাবে একটা চক্র এই কাজটা করে আসছে। এখন হয়তো আরও সক্রিয় হচ্ছে। অভিযোগ আছে পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলোতে হাঙ্গর পাচার করা হয়।
যে কারণে ঝুঁকিতে
ওয়াইল্ড লাইফ কনজার্ভেশন সোসাইটির সিনিয়র ম্যানেজার এলিজাবেথ ফাহরিন মানসুর বলেন, সাগরের বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় অন্যতম বড় ভূমিকা রাখে হাঙ্গর ও শাপলাপাতার মতো প্রজাতি। অতিরিক্ত আহরণে এসব প্রজাতি এখন সবচেয়ে হুমকীর মুখে। দেশে-বিদেশে অত্যন্ত মূল্যবান হওয়ায় জেলেরা দিন দিন হাঙ্গর ও শাপলাপাতা মাছ শিকারের দিকে ঝুঁকছে।
গবেষকরা বলছেন, বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশ ছাড়াও সাতটি উন্নয়নশীল দেশ দ্বারা বেষ্টিত (বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ড)। সামুদ্রিক সম্পদের উপর নির্ভরতার কারণে কয়েক দশক ধরে এই সমস্ত দেশ নজিরবিহীন নজরদারি মোতায়েন করেছে। এ অবস্থায় বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে কয়েক দশক ধরে সামুদ্রিক সম্পদের অত্যধিক মাছ ধরার কারণে সাগর থেকে হাঙ্গর ও শাপলাপাতা মাছ বিলুপ্তির ঝুঁকি তৈরী হয়েছে।
চট্টগ্রামের জেলা মৎস্য দপ্তরের সাবেক সহকারী পরিচালক বিক্রম জীৎ রায় বলেন, ১০ বছর আগেও বাংলাদেশে যে সংখ্যায় হাঙ্গর ছিল, এখন তা অনেক কমে এসেছে। মূলত বছর দুয়েক ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চমূল্যের কারণে হাঙ্গর ও স্টিং-রে শিকারের প্রবণতা বেড়েছে। এ কারণে বাংলাদেশে বড় আকারের হাঙ্গর প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
‘শার্ক ফিশারিজ ইন দ্য বে অব বেঙ্গল, বাংলাদেশ: স্ট্যাটাস অ্যান্ড পটেনশিয়ালিটিজ’ শিরোনামে তার রচিত গবেষণা নিবন্ধ বিক্রম জীৎ রায় উল্লেখ করেছেন, একসময় ১৫০-২০০টি যান্ত্রিক যানে বাণিজ্যিকভাবে হাঙ্গর আহরণ করা হতো। জাল ও বড়শির সাহায্যে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পটুয়াখালী, বরগুনা জেলার সাগর উপকূলে বাণিজ্যিকভাবে হাঙ্গর ধরা হতো। তখন বাণিজ্যিকভাবে হাঙ্গরের মাংস, চামড়া, পাখনা রপ্তানি হতো। সিঙ্গাপুর, হংকং, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশে বেশ চাহিদা ছিল।
২০০৮-২০০৯ সালে বাংলাদেশে ৩,৯৩৩ মেট্রিকটন হাঙ্গর ধরা হয়েছিল। তবে এর পরে দেশে হাঙ্গর শিকারের কোনো জরিপ হয়নি বলে জানান তিনি।
২০১৭ সালে পরিচালিত এক জরিপ অনুসারে বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে সালে ৬৭ হাজার, ৬৬৯ টি নৌকা এবং ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭০৭ মাছ ধরার জাল চালু রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে যান্ত্রিক, অ-যান্ত্রিক এবং শিল্প ট্রলারের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা অতিরিক্ত মাছ ধরার প্রাথমিক কারণ। যার ফলে হাঙ্গরসহ বিপন্ন প্রজাতির মাছের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।
এমভি শাহ আমানত ফিসিং ট্রলারের জেলে বদিউল আলম বলেন, একটা সময় ছিল যখন আমি পাঁচ থেকে ছয় দিনে কমপক্ষে এক হাজার হাঙ্গর ও শাপলাপাতা মাছ ধরতে পারতাম, সেখানে এখন আমি সাত দিন সাগরে থেকেও একটি হাঙ্গর পাচ্ছি না। এতে আমরা প্রচুর ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। ট্রলার মালিকদের কাছে জরিমানা গুনতে হচ্ছে।
সুরক্ষার কোনও পদক্ষেপ নেই
বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী ও মাছ সংরক্ষণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি আইন হল মাছের সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইন-১৯৫০ এবং বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২। ১৯৫০ সালের আইনে হাঙ্গর এবং স্টিং-রে রক্ষার কোনো বিধান ছিলোনা। ২০১২ সালের আইনে ২৩ টি সামুদ্রিক মাছের সুরক্ষার কথা বলা হয়।
সেই আইন বিদ্যমান থাকা অবস্থায় হাঙ্গর ও শাপলাপাতা মাছ ধরার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ এর তফসিল সংশোধন করে বিপন্ন হাঙ্গর ও রে মাছের ৫২ প্রজাতিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আইনের ৩৯ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে এসব প্রাণী আহরণ ও বিক্রির অভিযোগ প্রমানীত হলে তাঁকে এক বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। কোন ব্যক্তি একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে শাস্তির পরিমাণ দ্বিগুণ হবে। এমনকি এ অপরাধ সংঘটনে সহায়তাকারী বা প্ররোচনাকারীও নির্ধারিত দন্ডে দন্ডিত হবেন।
তবে হাঙ্গর ও স্টিং-রে সুরক্ষার একসব আইন শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। হাঙ্গর সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা বন অধিদপ্তরের এ নিয়ে দৃশ্যমান কোনো কাজ নেই। এই সুযোগ নিচ্ছে জেলে, ব্যবসায়ি ও পাচারকারীরা। বাংলাদেশের ৭১০ কিলোমিটার উপকূল রেখার প্রায় পুরোটা জুড়েই চলছে হাঙ্গর নিধন। সাগর পথে সে সব হাঙ্গর আসছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন মাছের আড়তে ও শুটকিপল্লিতে।
ওয়াইল্ড লাইফ কনজার্ভেশন সোসাইটির সিনিয়র ম্যানেজার এলিজাবেথ ফাহরিন মানসুর বলেন, “২০১২ সালের আইনে হাঙ্গর ও রে মাছের ২৩টি প্রজাতিকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ আইনের ফাঁক দিয়ে অনেকেই হাঙ্গরসহ বিভিন্ন মাছ অবৈধভাবে রপ্তানি করে আসছিলো। সুরক্ষায় নতুন আইন হলেও প্রয়োগ না থাকায় অবস্থার উন্নতি হয়নি।”
নিষিদ্ধ হাঙ্গর ও শালপাতা বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে। সরকারি নথিভুক্ত ১১ হাজার ৩৬৫ টি ফিসিং বোটসহ প্রায় ৭০ হাজার নৌ-যান নিয়মিত বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার করছে। কয়েক বছর আগেও হাঙ্গর বা রে মাছ জালে পড়লেই শুধু ধরতেন জেলেরা।
এখন সময় বদলেছে; বাণিজ্যিক মূল্য বাড়ায় নির্দিষ্টভাব এগুলো শিকারের জন্যই সাগরে ছুটছেন শিকারিরা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪৫
আপনার মতামত জানানঃ