বর্তমানে দেশের ২২টি গ্যাসক্ষেত্রে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ ১০ লাখ কোটি ঘনফুট। সে তুলনায় বার্ষিক ব্যবহার বা চাহিদা হচ্ছে এক লাখ কোটি ঘনফুট। তাই গত দুই দশকে কোনো নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হওয়ায় আগামী ১০ বছরের মধ্যেই প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ার মতো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।
গ্যাসের রিজার্ভ
২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আরপিএস এনার্জি লিমিটেড-এর হিসাব, ও সম্প্রতি আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাওয়া ধারণা অনুযায়ী, দেশের ২৭টি বাণিজ্যিক গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাসের মোট প্রমাণিত ও সম্ভাব্য মজুদ ২৯.৫৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।
তবে পেট্রোবাংলার উপাত্ত অনুযায়ী মোট গ্যাস মজুদের ২০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট ২০২১ সালের মধ্যে তুলে ফেলা হয়েছে।
বর্তমানে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো প্রতি বছর প্রায় ৯০০ বিলিয়ন ঘনফুট পরিমাণ গ্যাস উৎপাদন করে। এভাবে গ্যাস উৎপাদন হতে থাকলে কেবল আগামী ১০ বছর পর্যন্ত দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন করা যাবে।
আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশে যদি বড় কোনো গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া না যায়, তাহলে বিভিন্ন খাতের শিল্পের প্রবৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব
গত এক দশকে ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে চাহিদা তথা ব্যবহার বেড়েছে। এরমধ্যে গ্যাসের বড় কোনো মজুদও আবিষ্কার না হওয়ায়, বাংলাদেশে স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন ইতোমধ্যেই লক্ষণীয়ভাবে কমছে। ফলশ্রুতিতে, জীবাশ্ম জ্বালানি উৎসটির ঘাটতি দেখা দিয়েছে এবং বেড়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি।
রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি- পেট্রোবাংলার প্রদত্ত তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে গ্যাসের দৈনিক ব্যবহার হচ্ছে ৩ হাজার ১২৬ মিলিয়ন ঘনফুট। এরমধ্যে ২ হাজার ২৮৪ মিলিয়নের যোগান আসছে স্থানীয় উৎস থেকে, বাকিটা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি হচ্ছে।
২০২০ সালে, স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলি দৈনিক ২,৫৭০.৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন (উত্তোলন) করেছিল।
দুই বছরের ব্যবধানে, স্থানীয়ভাবে গ্যাস উৎপাদন প্রতিদিন ২৮৬.৪ মিলিয়ন ঘনফুট কমেছে। এবং ফলস্বরূপ, অভ্যন্তরীণ উৎসের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যেকার ব্যবধান পূরণে এলএনজি আমদানিতে নির্ভরতা বাড়ছে।
কিন্তু, বৈশ্বিক বাজারে এলএনজির মূল্যে এখন দেখা যাচ্ছে অস্থিতিশীল প্রবণতা। ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি নিষিদ্ধ করছে, অথচ রাশিয়াই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ গ্যাস উৎপাদক। এসব ঘটনা বাংলাদেশের সামনে এরমধ্যেই দামি হয়ে ওঠা জ্বালানিটির সরবরাহ পাওয়ার ক্ষেত্রে সমূহ বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গ্যাস অনুসন্ধানে ব্যর্থতা
বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সচল গ্যাসক্ষেত্রগুলির মজুদ ফুরিয়ে আসার সাথেসাথে নতুন গ্যাস বেসিন আবিস্কারে ধীরগতির অনুসন্ধান কাজ অশনি সংকেত, এটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বড় ব্যাঘাতের পূর্বাভাস।
তারা বলেছেন, “অবিলম্বে যদি একটি কঠোর গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম গ্রহণ করা না হয়, তাহলে তৈরি পোশাক কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সার কারখানাসহ গ্যাসভিত্তিক শিল্প অবকাঠামো হঠাৎ সরবরাহ কমে যাওয়ায় একটি বড় ধাক্কার সম্মুখীন হবে।”
গ্যাসের নতুন মজুদ খুঁজে পাওয়া ও নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন বিস্ফোরণ ও কূপ খনন। যত বেশি বিস্ফোরণ, তত বেশি গ্যাস মজুদ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা।
প্রতিবেশী দেশ ভারত তাদের গ্যাস কূপ খননের কার্যক্রম প্রতি বছর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করেছে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কর্পোরেশন ৩৮৬টি কূপ খনন করেছে। ২০১৭ অর্থবছরে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০১-এ।
কিন্তু বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম খুবই নগন্য। পেট্রোবাংলা’র তথ্য অনুযায়ী, গত ১৩ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত অনুসন্ধান কোম্পানিগুলো ও আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে কেবল ১৭টি কূপে বিস্ফোরণ কাজ চালিয়েছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) ১৪টি কূপ খনন করেছে, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল) তিনটি, ও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) একটি করে কূপ খনন করেছে।
১৭টি কূপের মধ্যে সাতটি কূপ বাণিজ্যিকভাবে টেকসই হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। তবে আনুমানিক মজুদের পরিমাণ খুব বেশি ছিল না।
সাধারণত, গ্যাস অনুসন্ধানের বৈশ্বিক সাফল্যের হার প্রতি সাত কূপে একটি। কিন্তু বাংলাদেশে এ অনুপাত প্রতি তিন কূপে একটি।
গ্যাস অনুসন্ধানে প্রায় দ্বিগুণ সাফল্যের হার থাকা সত্ত্বেও দেশে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের কাজ এখনো যথাযথ মনোযোগ পায়নি।
বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধান প্রচণ্ডভাবে উপেক্ষিত মন্তব্য করে বদরুল ইমাম বলেন, এত বেশি অনুসন্ধান-হার থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে কম গ্যাস অনুসন্ধান করা জায়গাগুলোর একটি। এ সমস্যা সমাধানে তিনি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করার পরামর্শ দেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩১০
আপনার মতামত জানানঃ