২০২৩ সালে হতে যাওয়া আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে গুম, ক্রসফায়ারের মতো ঘটনা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় থাকতে জঙ্গি ইস্যু প্রচার করে পশ্চিমাদের সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করবে।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লায় ডিবি পুলিশ পরিচয়ে একদল লোক সেলিম মোল্লা (৫১) নামের এক ব্যবসায়ীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ ঘটনায় ওই ব্যবসায়ীর স্ত্রী বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় অপহরণের মামলা করলেও ২৪ দিন পরও পুলিশ ওই ব্যবসায়ীকে উদ্ধার করতে পারেনি।
এ ঘটনায় ওই ব্যবসায়ীর পরিবার শঙ্কা ও আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে। এদিকে ডিবি ওই ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
যেভাবে অপহৃত হলেন ব্যবসায়ী
অপহৃত ব্যবসায়ীর স্ত্রী রোমা হক মামলায় উল্লেখ করেন, তার স্বামী সেলিম মোল্লা কিছুদিন বসুন্ধরা গ্রুপের মেকানিক্যাল বিভাগে চাকরি করতেন। সেখান থেকে দুই বছর আগে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে সদর উপজেলার ফতুল্লার তক্কার মাঠ এলাকার বাড়িতে থাকতেন এবং বিভিন্ন স্থানে জমিজমা কেনাবেচার ব্যবসা করতেন।
জমিজমার ব্যবসায় কারও সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল কি না, তা তার জানা নেই। গত ২১ মার্চ রোমা হক সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যান। বাসায় তাঁর স্বামী সেলিম মোল্লা একা ছিলেন।
গত ২৩ মার্চ সকাল ৯টার দিকে তার বাড়ির মালিক গিয়াস উদ্দিন তাকে মুঠোফোনে জানান, তার স্বামী সেলিম মোল্লাকে সকাল আটটার দিকে অজ্ঞাতনামা চার-পাঁচজন ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে বাসা থেকে একটি কালো মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গেছেন।
ওই ঘটনার পর তাৎক্ষণিকভাবে বাড়ি ফিরে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও স্বামীর সন্ধান পাননি। এ ঘটনায় গত ২৬ মার্চ ফতুল্লা মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তিনি।
মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়, পরবর্তী সময় রোমা হক তার ভাড়া বাসার পাশের একটি কারখানার সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখতে পান, অজ্ঞাতনামা চার-পাঁচজন একটি কালো হাইয়েস মাইক্রোবাসে তাঁর স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছেন। এখন পর্যন্ত কোথাও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
মামলার বাদী বলেন, তার স্বামীর বন্ধু ইসমাইলকে (৫০) একই তারিখে গুলিস্তান থেকে অজ্ঞাতনামা লোকজন একই ভাবে তুলে নিয়ে যান। পরবর্তী সময় তাকে ২৯ মার্চ রাতের অন্ধকারে তার বাসার সামনে চোখ বাঁধা অবস্থায় নামিয়ে দিয়ে যায়।
ওই ঘটনার সংবাদ পেয়ে ইসমাইলের দ্বারস্থ হয়ে স্বামীর বিষয়ে জানতে চান তিনি। ইসমাইল সন্তোষজনক জবাব না দিয়ে একেক সময় একেক ধরনের কথা বলেন। বাদীর ধারণা, যেকোনো কারণে হোক, পরিকল্পিতভাবে তার স্বামীকে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে রেখেছে দুর্বৃত্তরা।
রোমা হক বলেন, ‘আমার স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা জিডি নেই। তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত নন।’ তিনি বলেন, তাদের সংসারে দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ছেলের বয়স পাঁচ বছর এবং ছোট মেয়ের বয়স দুই বছর।
বাড়িওয়ালা দেলোয়ারা আহমেদ বলেন, এক বছর ধরে তাদের বাড়িতে ভাড়া আছেন সেলিম মোল্লা। সাদা পোশাকের লোকেরা প্রথমে আইনের লোক পরিচয়ে দেন। কিসের আইনের লোক জানতে চাইলে তারা নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বলেন, তারা ভাড়াটিয়া সেলিম মোল্লাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যান।
এ বিষয়ে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিবি) তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘ডিবি পুলিশ সেলিম মোল্লা নামের কাউকে তুলে আনেননি। যেহেতু ডিবি পুলিশ পরিচয় ব্যবহার করা হয়েছে, আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’
ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রকিবুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় অপহরণ মামলা হয়েছে। তাকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
নির্বাচনের আগে বাড়বে গুম-হত্যা
এদিকে, দেশে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে গুম, ক্রসফায়ারের মতো ঘটনা বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র মতে, ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পরবর্তী তিন বছরে ৭১টি গুমের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস)। এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণার বরাত দিয়ে সিজিএস বলছে, এই তিন বছরে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা গুমের শিকার হয়েছেন সবচেয়ে বেশি।
এছাড়া বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ৫২২ ব্যক্তি গুমের শিকার হন।
২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যে ৭১টি গুমের ঘটনা ঘটে, সেগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৭১ জনের মধ্যে ১৬ জন এখনো নিখোঁজ এবং ৫ জন হত্যার শিকার হয়েছেন।
এ ছাড়া ২২ জনকে পরবর্তীতে আটক কিংবা গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। ২৩ জন গুম হওয়ার পর ফেরত এসেছে এবং ৫ জন সম্পর্কে কোনো তথ্য জানাতে পারেনি সিজিএস।
তবে যে ৫১ জনের পেশা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে তাতে দেখা গেছে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা গুমের শিকার হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এই দুই পেশার ১১ জন করে গুমের শিকার হয়েছেন।
যে ৫২টি গুমের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়া এলিট ফোর্স র্যাব ২১টি এবং ডিবি ১৬টি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সিআইডিসহ নানা বাহিনীর জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে।
এর মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ২৬টি গুমের ঘটনা ঘটেছে। আর গত বছরের জুনে সবচেয়ে বেশি ৮ জন ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন। বর্তমান সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর ২০১৯ সাল থেকে পরবর্তী তিন বছরে ৭১টি গুমের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস)।
নির্বাচনের আগে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা এম্বুলেন্সে করে পালিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ি থেকে নামিয়ে তুলে নেয়া এবং পরবর্তীতে তাদের লাশ খুঁজে না পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। গুমের শিকার ব্যক্তিরা ফেরত আসার পরে তাদের অনেকের বর্ণনা থেকে এটাই স্পষ্ট রাষ্ট্রের ভেতরে দেশের অভ্যন্তরে এমন কিছু স্থান আছে যেটা এক ধরনের গোপন কারাগার হিসেবে গড়ে উঠেছে।
আগামী ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে জঙ্গি উথানের একটি পর্ব দেখানোর চেষ্টা হতে পারে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা। এটাকে কেন্দ্র করে দেশে অনেক মানুষ গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও ক্রসফায়ারের শিকার হতে পারেন। এবং একটি পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মধ্যদিয়ে গুমের ঘটনা খানিক সময়ের জন্য কমে এসেছে।
কিন্তু তার মানে বলার সুযোগ নেই যে, এই ঘটনা আবার ঘটবে না। এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে দিয়ে আমরা দেখছি কমে এসেছে। পাশাপাশি এ ধরনের গুম, খুন কমে গেছে এটি বলার কোনো সুযোগ নেই।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যারা গুম হচ্ছে তারা খুন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হচ্ছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুম একই সূত্রে গাঁথা। ক্ষমতাসীনরা তাদের অবৈধ সম্পদ রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ক্ষেত্রবিশেষে তারা গুমের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে।
তিনি বলেন, প্রাইভেটাইজেশন ভায়োলেশন বা দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নে জড়িত ব্যক্তিরা এক্ষেত্রে গুম-খুনের ঘটায় তাদের ভাড়া করা কিংবা নিজেদের সৃষ্টি করা বাহিনী ব্যবহার করে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গুমটাকে ব্যবহার করা হচ্ছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে এই (গুম) সমস্যা আরও প্রকট হবে। আরেকটি কারণে রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে এটা ব্যবহৃত হচ্ছে। দুর্নীতির কারণে যারা এখন বিরাট অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন তারা তাদের সম্পত্তি রক্ষা করতে ব্যক্তিগত বাহিনী তৈরি করছে। এবং তারা সরকারি বাহিনীকে ব্যবহার করছে। এটা আমাদেরকে একটি বেসামাল পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ