লালমনিরহাটে পুলিশ হেফাজতে রবিউল ইসলাম (২৫) নামে এক পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিবাদে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে এলাকাবাসী। বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) মধ্যরাতে সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর বাজারে লালমনিরহাট-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে এলাকাবাসী।
নিহত রবিউল ইসলাম খাঁন সদর উপজেলার হারাটী ইউনিয়নের কাজীরচওড়া এলাকার দুলাল খানের ছেলে আটক অপর পোল্লাদ রায় দক্ষিণ হিরামানিক এলাকার মৃত রসনি চন্দ্রের ছেলে।
নিহতের স্বজনদের দাবি, পুলিশ নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, সদর উপজেলার হারাটি ইউনিয়নের হিরামানিক এলাকার ১লা বৈশাখ উপলক্ষে বৈশাখী মেলা চলছিল। এসময় সেখানে কিছু জুয়ারী ডাবু (ছয়গুটি) জুয়া খেলা বসালে সেখানকার এক ব্যাক্তি ৯৯৯ নম্বরে ফোন দেয়। পরে সাথে সাথে সেখানে পুলিশ এসে জুয়ারীদের ধাওয়া করলে তারা পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মেলায় ঘুরতে আসা শ্রী পোল্লাদ মেকার ও রবিউল ইসলাম নামে দুইজনকে আটক করে।
স্থানীয়রা জানান, পুলিশ আটক দুজনকে ভ্যানে উঠানোর চেষ্টা করলে রবিউল ভ্যানে উঠতে রাজি হয়নি। পরে পুলিশ তাকে বেদম মারপিট করে। এতে রবিউল সেখানেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরে পুলিশ তাকে পাজা কোলা করে তাদের ভ্যানে তুলে থানায় নিয়ে আসে। পুলিশের নির্যাতনের কারণেই রবিউল অসুস্থ হয় এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে তারা জানান।পুলিশের নির্যাতনে ঘটনাস্থলেই রবিউলের মৃত্যু হয়েছে বলে স্বজনরা অভিযোগ করছেন।
এদিকে রবিউলের মৃত্যুর খবরে রাত ২ টার পর থেকে উপজেলার মহেন্দ্রনগরে লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়ক অবরোধ করে স্থানীয়রা।সড়ক অবরোধকারীরা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে নির্যাতনকারী পুলিশকে দ্রুত আইনের আশ্রয়ে আনার দাবি জানান।এসময় তারা পুলিশের একটি গাড়ি ভাংচুর করে।পরে ভোর চারটার দিকে লালমনিরহাট সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শাহা আলম অবরোধকারীদের তদন্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানালে অবরোধকারীরা অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়।
রবিউলের পরিবার ও স্থানীয়দের দাবি, এক সপ্তাহে আগে রবিউল বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। মেলার খবর পেয়ে বেড়াতে যান সেখানে। রবিউল জুয়া খেলেননি, তাই পুলিশ ভ্যানে উঠতে রাজি হচ্ছিলেন না। এ জন্য পুলিশ তাকে মারধর করে ভ্যানে তুলে নিয়ে যায়। পুলিশের লাথিতে অণ্ডকোষে আঘাতপ্রাপ্ত হন তিনি। কিন্তু দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা এতে পাত্তা না দিয়ে বলেন, রবিউল অভিনয় করছেন।
পুলিশ তাকে মারধর করে ভ্যানে তুলে নিয়ে যায়। পুলিশের লাথিতে অণ্ডকোষে আঘাতপ্রাপ্ত হন তিনি। কিন্তু দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা এতে পাত্তা না দিয়ে বলেন, রবিউল অভিনয় করছেন।
লালমনিরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম বলেন, জুয়া খেলার খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দুইজনকে আটক করে। থানায় আসার পথে রবিউল অসুস্থ অনুভব করলে তাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে রংপুর মেডিকেলে নেয়ার প্রস্তুতিকালে তার মৃত্যু হয়।
দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা বন্দুকযুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা আগের থেকে কমলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু আবারও অত্যন্ত উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে বলে সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। মার্চ মাসের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যালোচনা করে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে হুমকি ও হামলা, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, কারা হেফাজতে মৃত্যু, সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংসতা, সীমান্তে হতাহতের মতো ঘটনা বন্ধ হয়নি বরং বেড়েছে।
মার্চ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। অপরদিকে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের পর দুইজনের কারাগারে মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নির্যাতনের একপর্যায়ে ভয়ে পালিয়ে যাওয়া অভিযুক্তকে মৃত অবস্থায় ডোবা থেকে উদ্ধার, থানার ভেতরে অন্তঃসত্ত্বার পেটে লাথি মেরে গর্ভপাত ঘটানো, দাবিকৃত টাকা দিতে না পারায় থানার ভেতরে দুই ব্যক্তিকে নির্যাতন ও হাসপাতালে জরুরি বিভাগে কর্মরত ব্রাদারকে মারধর করা এবং আরেক ঘটনায় এক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নিজ স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে।
এমএসএফ মনে করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ ও পরবর্তীতে কারা হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুতর ও অগ্রহণযোগ্য। ঘটনাগুলোর তদন্তপূর্বক জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক।
এমএসএফের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, মার্চ মাসে কারা হেফাজতে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে মধ্যে ছয়জন কয়েদি ও এক বিদেশি নারীসহ চারজন হাজতি।
কারাগারে অপর্যাপ্ত চিকিৎসার কারণে বন্দিরা যথাযথ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বন্দি অসুস্থ হলে তাকে কারাগারের বাইরে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, নয়তো হাসপাতালে নেয়ার আগেই অধিকাংশ বন্দির মৃত্যু হয়।
এমএসএফ বিশ্বাস করে যে কারাগারের অভ্যন্তরে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাগুলো সঠিকভাবে তদন্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের সংবিধান বলছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে’ (৩১ অনুচ্ছেদ)। নবম সংসদে পাস করা ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) বিল, ২০১৩ ’-এ সরকারের হেফাজতে থাকা অবস্থায় কারও ওপর নির্যাতন চালানোকে অপরাধ বলে বর্ণনা করে এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির বিধান করা হয়েছে।
বাংলাদেশের আইন বলছে, ‘হেফাজতে মৃত্যু’ বেআইনি কাজ, অপরাধ। তারপরও এর বিচার হয় না। ২০১৩ সালের আইনে এ পর্যন্ত বিচার হয়েছে একটি।
হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার বিচার হয় না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবার অভিযোগও করে না। পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা নেওয়ার উদাহরণ বিরল বললেও বাড়িয়ে বলা হয়। কিন্তু অভিযোগ না করেও পরিবারের যেসব অভিজ্ঞতা তা জানলেই বোঝা যায়, কেন কারও পক্ষে অভিযোগ করার সাহস দেখানো সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে হত্যাকে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ধরনের মানসিকতাই যে সহযোগী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই কাজে পরোক্ষ ভূমিকা পালনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও যে পিছিয়ে নেই, তা এই প্রতিষ্ঠানের নির্লিপ্ততাতেই স্পষ্ট। কমিশন একবার বলেছিল যে বেছে বেছে কয়েকটা ঘটনার তদন্ত করবে, সেই কথা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কমিশনের জবাবদিহির অভাব পুলিশ এবং সরকারের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
তারা বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে পুলিশ নিজেরাই তদন্ত করে, ফল যা হওয়ার তা-ই হয়, যে পুলিশ মামলাই নিতে চায় না, তার হাতে তদন্তের ভার দিলে এর চেয়ে ভিন্ন কিছু হওয়ার কারণ নেই। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য কোনো স্বাধীন কমিশন গঠনের ইচ্ছা বা আগ্রহ যে সরকারের নেই, তা-ও সহজেই বোধগম্য।
আরও বলেন, পুলিশের কর্মকর্তারা একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি করেছেন, যেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিল করে দেওয়া হয়। এই দাবি একেবারে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে এমন নয়। তদুপরি, পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে, তাতে এই বাহিনীর সদস্যরা যে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বেই ভাববেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই; হেফাজতে মৃত্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা সেগুলো প্রতিদিন প্রমাণ করে দিচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৯
আপনার মতামত জানানঃ