ইন্দোনেশিয়ায় সিরিয়াল ধর্ষণে অভিযুক্ত এক মাদ্রাসাশিক্ষককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। হেরি বীরাওয়ান নামের ওই শিক্ষক একটি আবাসিক মাদ্রাসায় একে একে ১৩ ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন। ধর্ষণের শিকার এসব মাদ্রাসাছাত্রীর বয়স ১২ ও ১৬ বছরের মধ্যে।
সোমবার (৪ এপ্রিল) এ শিক্ষকের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষণা করেন বান্দুংয়ের একটি আদালত। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এ খবর জানানো হয়েছে।
খবরে বলা হয়েছে, সিরিয়াল ধর্ষণের মামলার শুনানির পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ওই শিক্ষককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি নতুন করে পর্যালোচনার পর সোমবার সেই সাজা স্থগিত করে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন আদালত।
মাদ্রাসা শিক্ষক হেরি বীরাওয়ানের ধর্ষণের এই ঘটনা ইন্দোনেশিয়ায় ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি করেছিল এবং দেশটির ধর্মীয় আবাসিক মাদ্রাসায় শিশুদের যৌন সহিংসতা থেকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে।
গত ফেব্রুয়ারিতে বান্দুং শহরের একটি আদালত ওই শিক্ষককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। পরে প্রসিকিউটররা এই সাজা স্থগিত চেয়ে সর্বোচ্চ সাজার আপিল করেন। সোমবার বান্দুং হাই কোর্টের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে বিচারক বলেছেন, আমরা মামলার বিবাদীর মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষণা করেছি।
তবে আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন কি না সে বিষয়ে শিক্ষক হেরির আইনজীবী ইরা ম্যামবো মন্তব্য জানাতে অস্বীকার করেছেন। আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর এ বিষয়ে মন্তব্য করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
স্থানীয় প্রসিকিউটরের কার্যালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, মন্তব্য করার আগে চূড়ান্ত রায়ের কপির অপেক্ষা করছি। গত ফেব্রুয়ারিতে আদালতের একজন বিচারক বলেন, ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে শিক্ষক হেরি একটি মাদ্রাসার অন্তত ১৩ ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন করেন। ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী এই ছাত্রীদের মধ্যে ৮ জনই গর্ভবতী হয়েছিল।
ইন্দোনেশিয়ার শিশু সুরক্ষামন্ত্রীসহ দেশটির সরকারি কর্মকর্তারাও আলোচিত এই ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষকের মৃত্যুদণ্ডের সাজার দাবি তোলেন। তবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতাকারী ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বলেছে, এই সাজা যথাযথ নয়।
বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইন্দোনেশিয়ায় হাজার হাজার আবাসিক মাদ্রাসা ও অন্যান্য ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশটির দরিদ্র পরিবারের শিশুরা শিক্ষার সুযোগ পান।
গত বছরের মে মাসে শিক্ষার্থীদের ওপর বছরের পর বছর ধরে চলা নির্যাতনের বিষয়টি ধরা পড়ে। একজন ভুক্তভোগীর বাবা-মা তাদের সন্তান গর্ভবতী হওয়ার পর বিষয়টি প্রকাশ পায়।
২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে শিক্ষক হেরি একটি মাদ্রাসার অন্তত ১৩ ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন করেন। ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী এই ছাত্রীদের মধ্যে ৮ জনই গর্ভবতী হয়েছিল।
ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বীরাওয়ান দরিদ্র এলাকার শিক্ষার্থীদের বৃত্তি এবং অন্যান্য প্রণোদনা দেওয়ার মাধ্যমে তার মাদ্রাসায় পড়ার জন্য আকৃষ্ট করতেন। ভর্তি হওয়ার পর মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করতো। বছরে মাত্র একবার বাড়ি যেতে দিত।
ইন্দোনেশিয়ায় ২৫ হাজারের বেশি বোর্ডিং স্কুল আছে। এসব স্কুলে ৫০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। সম্প্রতি এসব প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন বেড়েছে আশঙ্কাজনকহারে।
গত বছর দক্ষিণ সুমাত্রার একটি মাদ্রাসার দুই শিক্ষক গ্রেপ্তার হন ২৫ ছাত্রকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে। পূর্ব জাভায় ২০২০ সালে ১৫ ছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে এক শিক্ষকের ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নির্যাতনের খবরে শিউরে উঠছে সারা দেশ। যদিও মাদ্রাসাগুলোতে ক্রমবর্ধমান এই ধর্ষণ নিয়ে মাথাব্যথা নেই সরকারের। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরব নয়। নেই বার্ষিক কোন প্রতিবেদন। তাই এই সব নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র থেকে যাচ্ছে অজানা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীরা লজ্জা, ভয়, নানান কিছুর কারণে তা প্রকাশ করে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সবথেকে কম কথা বলা হয়। এর কারণ হয়তো সেক্স, অপ্রাপ্তবয়স্ক ভুক্তভোগী এবং ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মানুষের অন্ধবিশ্বাস।
মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক একের পর এক শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা মাদ্রাসা বিষয়ে দেশবাসীর নিকট এক নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেকে মনে করেন এরা আদব কায়দা শিক্ষা দেন। নৈতিকতা শিক্ষা দেন। সে কারণে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে হোক বা নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পড়াতে দেন। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, যে নিরাপত্তার কথা ভেবে মাদ্রাসায় ছেলেমেয়েদের পড়াতে দেয়া হয় সেখানে আদৌ নিরাপদ নয়। দেখা যায় ছেলেরাও নিরাপদ নয় এসব তথাকথিত হুজুরদের কাছে। এটিও সমাজের বৈকল্যতা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৮
আপনার মতামত জানানঃ