ইন্দোনেশিয়ার সরকার সব ধরনের সিরাপ ও তরল ওষুধ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। চলতি বছর দেশটিতে প্রায় ১০০ শিশু তীব্র কিডনি জটিলতায় (একেআই) মারা যাওয়ার পর সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আনন্দবাজার পত্রিকায় বলা হয়, কিছু দিন আগেই জ্বর বা কাশির সিরাপ খেয়ে গাম্বিয়ায় অন্তত ৭০টি শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) তরফে জানানো হয়েছিল, ভারতের নয়াদিল্লির একটি সংস্থার বানানো চারটি কাফ সিরাপ থেকে গাম্বিয়ায় শিশুদের পর পর মৃত্যুর ঘটনার যোগ পাওয়া গিয়েছে। গুরুতর এই অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু করে ভারত সরকার।
তার পরে আজই ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে জানায়, গত জানুয়ারি থেকে এখনও পর্যন্ত কিডনির অসুখে (ডাক্তারি পরিভাষায় অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরি বা একেআই) দেশে মোট ৯৯টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, শিশুমৃত্যুর এই হার বেড়েছে গত অগস্ট থেকে। কিডনির অসুখে কম-বেশি শিশুমৃত্যুর ঘটনা ইন্দোনেশিয়ায় নতুন নয়।
কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে, এ বছর সেই সংখ্যাটা এক লাফে অনেকটা বেড়েছে। আগে যেখানে মাসে এক থেকে দু’টি শিশুর একেআই-এর চিকিৎসা করতে হত, সেখানে এখন শুধু রাজধানী জাকার্তাতেই এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা বেড়েছে ৬৫ শতাংশ।
ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মাদ সেহরিল মানসুর জানান, বুধবার পর্যন্ত ২২ প্রদেশ থেকে ৯৯ মৃত্যুসহ ২০৬টি রিপোর্ট রেকর্ড করা হয়।
মানসুর বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শিশুদের কিডনি জটিলতা শুরু হয়, যা জটিল আকার ধারণ করে আগস্টে। গত সপ্তাহ থেকে এ বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, পূর্ব সতর্কতার অংশ হিসেবে সাময়িকভাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের তরল ওষুধ প্রিসক্রিপশনে লিখতে নিষেধ করা হয়েছে। তাছাড়া তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সব ধরনের ওষুধের দোকানকে প্রিসক্রিপশনের বাইরে তরল ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে বলা হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার খাদ্য ও ওষুধ বিভাগ জানিয়েছে, যেসব ওষুধ খেয়ে গাম্বিয়ায় শিশুদের মৃত্যু হয়েছে তা এখানে নেই। গাম্বিয়ায় ৭০ শিশুর মৃত্যুর পেছনে যে চারটি কফ সিরাপকে দায়ী করা হচ্ছে সেগুলো যে উপাদান দিয়ে তৈরি সেই ডাইইথিলিন গ্লাইসল ও ইথিলিন গ্লাইসলের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে ইন্দোনেশিয়া। গাম্বিয়ায় যে চারটি কফ সিরাপকে শিশু মৃত্যুর জন্য দায়ী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরীক্ষায় সেগুলোতে অননুমোদিত মাত্রায় ডাইইথিলিন গ্লাইসল এবং ইথিলিন গ্লাইসল পাওয়া গেছে। চারটি কফ সিরাপই ভারতে তৈরি।
গাম্বিয়ায় ৭০ শিশুর মৃত্যুর পেছনে যে চারটি কফ সিরাপকে দায়ী করা হচ্ছে সেগুলো যে উপাদান দিয়ে তৈরি সেই ডাইইথিলিন গ্লাইসল ও ইথিলিন গ্লাইসলের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে ইন্দোনেশিয়া।
ইন্দোনেশিয়ার খাদ্য ও ওষুধের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিপিওএম থেকে বলা হয়, কোনো দ্রাবক তৈরিতে ডাইইথিলিন গ্লাইসল ও ইথিলিন গ্লাইসল ব্যবহার করা হয়েছে কিনা তারা তা তদন্ত করে দেখছে।
বিপিওএমর বিবৃতিতে আরো বলা হয়, জনসাধারণকে সুরক্ষা প্রদানের জন্য বিপিওএম নিবন্ধনের সময় একটি প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক সবার জন্য ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয় এমন সব ধরনের সিরাপে দ্রাবক হিসেবে ডাইইথিলিন গ্লাইসল ও ইথিলিন গ্লাইসল ব্যবহারের অনুমতি আর দেওয়া হবে না। অতিরিক্ত মাত্রার ডাইইথিলিন গ্লাইসল ও ইথিলিন গ্লাইসল মানুষের জন্য ক্ষতিকারক এবং শরীরে নেওয়ার পর তা মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
মেইডেন ফার্মাসিউটিক্যালস তার ভারতীয় কারখানাগুলোতে ওষুধ উৎপাদন করে থাকে। কোম্পানিটির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, সেসব ওষুধ স্থানীয়ভাবে বিক্রির পাশাপাশি এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে রপ্তানি করা হয়।
ভারতের মেইডেন ফার্মাসিউটিকেলের বানানো কফ সিরাপ চারটি হল: প্রোমেথাজাইন ওরাল সল্যুশন, কোফেক্সমালিন বেবি কফ সিরাপ, ম্যাকফ বেবি কফ সিরাপ ও ম্যাগ্রিপ এন কোল্ড সিরাপ।
এই সিরাপগুলোর উৎপাদন ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিয়মবিধির কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়ার মধ্যে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এসব সিরাপ বিক্রি বন্ধ রাখতে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দিয়েছে এবং মেইডেন ফার্মাসিউটিক্যাল ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে নিয়ে এ বিষয়ে ‘আরও তদন্তের’ ঘোষণা দিয়েছে।
মেইডেন ফার্মাসিউটিক্যাল বলেছে, তারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মান বজায় রেখে ওষুধ প্রস্তুত করে। যদিও তাদের তৈরি কিছু ওষুধ ভারতেই জাতীয় বা রাজ্য পর্যায়ে মান নিয়ন্ত্রণের পরীক্ষায় উৎরাতে পারেনি।
এই কোম্পানির ওষুধ নিয়ে সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী:
#এই কোম্পানির একটি সিরাপ রাজ্য পর্যায়ের মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার পর ২০১১ সালে বিহার রাজ্যে মেইডেন ফার্মাসিউটিকালকে কালো তালিকাভূক্ত করা হয়।
#ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করায় ২০১৮ সালে ভারতের জাতীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করে।
#এই কোম্পানির ওষুধ ২০২০ সালে জম্মু ও কাশ্মীরে মান-নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়।
#সর্বশেষ ২০২২ সালে মেইডেন ফার্মাসিউটিক্যালের ওষুধ কেরালা রাজ্যে মান নিয়ন্ত্রণের পরীক্ষায় চার চারবার ব্যর্থ হয়।
হরিয়ানা রাজ্যের এই ওষুধ কোম্পানিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, গাম্বিয়ায় শিশু মৃত্যুর খবর পেয়ে তারা ‘হতবাক’ হয়েছে। কারণ, তারা ‘খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং হরিয়ানা রাজ্যের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সব ধরনের প্রোটোকল অনুসরণ করে’।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৮
আপনার মতামত জানানঃ