মহাকাশ অভিযানের সার্থকতা সম্পর্কে যারা প্রশ্ন তোলেন, হাবল টেলিস্কোপের কাহিনি তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট হওয়া উচিত৷ প্রাথমিক ব্যর্থতা কাটিয়ে মহাকাশের এই চোখ একের পর এক বিস্ময়কর আবিষ্কার করে চলেছে৷
এ পৃথিবী থেকে বহুদূরে, এত দূরে যে দূরত্ব কল্পনা করাও মুশকিল, প্রায় ১৪০০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং বা মহা বিস্ফোরণের পর প্রথম যে নক্ষত্রগুলির জন্ম হয়েছিল সেগুলোর একটি ধরা পড়েছে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ-এর চোখে। খবর আনন্দবাজার
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ‘ইয়ারেন্ডেল’ নামের এই নক্ষত্রের জন্ম হয়েছিল বিগ ব্যাং-এর পর ঘন জমাট অন্ধকার ফুঁড়ে মহাবিশ্বে যখন সবে ভোরের আলো (কসমিক ডন) ফুটছে।
‘ইয়ারেন্ডেল’ নামের অর্থ হচ্ছে—ভোরের তারা। ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পর থেকে সভ্যতা এখনও পর্যন্ত যে তারা বা নক্ষত্রগুলির হদিশ পেয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন আর এই সৌরমণ্ডল থেকে সবচেয়ে দূরে রয়েছে এই ‘ইয়ারেন্ডেল’-ই।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, এই নক্ষত্রটির জন্ম হয়েছিল বিগ ব্যাং-এর পরের ৯০ কোটি বছরের মধ্যেই। জন্মের পর থেকে এই মহাবিশ্ব বা ব্রহ্মাণ্ড উত্তরোত্তর বেশি গতিতে চারপাশে ফুলেফেঁপে উঠছে বলে এই সদ্য আবিষ্কৃত নক্ষত্রটি এখন সৌরমণ্ডল থেকে রয়েছে ২ হাজার ৮০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে।
হাব্ল-এর এই অভূতপূর্ব আবিষ্কারের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘নেচার’-এ।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় ও বাল্টিমোরের স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী, গবেষকরা জানিয়েছেন, এই তারাটি এত দূরে রয়েছে যে তার আলো পৃথিবীতে পৌঁছতে সময় লেগেছে এক হাজার ২৯০ কোটি বছর।
মহাবিশ্বের এই প্রাচীনতম নক্ষত্র আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে মহাকাশে হাব্ল টেলিস্কোপ চার বছর আগে গড়া তার পুরনো রেকর্ডও ভেঙে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। ২০১৮ সালে হাব্ল টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের যে প্রাচীনতম নক্ষত্রের হদিশ দিয়েছিল তার জন্ম হয়েছিল বিগ ব্যাং-এর ৪০০ কোটি বছর পর। যখন এই মহাবিশ্বের বয়স ছিল এখনকার বয়সের এক-তৃতীয়াংশেরও কম। আর সদ্য আবিষ্কৃত নক্ষত্র ইয়ারেন্ডেল-এর জন্ম হয়েছিল তার বহু বহু আগে। বিগ ব্যাং-এর পরের ৯০ কোটি বছরের মধ্যেই। যখন এই মহাবিশ্বের বয়স ছিল এখনকার বয়সের মাত্র সাত শতাংশ।
এ পৃথিবী থেকে বহুদূরে, এত দূরে যে দূরত্ব কল্পনা করাও মুশকিল, প্রায় ১৪০০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং বা মহা বিস্ফোরণের পর প্রথম যে নক্ষত্রগুলির জন্ম হয়েছিল সেগুলোর একটি ধরা পড়েছে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ-এর চোখে।
মূল গবেষক জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক ব্রায়ান ওয়েল্চ বলেছেন, ‘মহাবিশ্বে ভোরের আলো ফোটার সময়ের একা কোনও নক্ষত্রের হদিশ এর আগে মেলেনি। ওই সময় ছায়াপথের হদিশ কিছু মিলেছে যদিও। তবে সেগুলির খুব আবছা আলো পাওয়া গিয়েছে এর আগে। যে আলো থেকে একক ভাবে কোনও তারাকে দেখা এর আগে কোনও টেলিস্কোপের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। কারণ সেখানে লক্ষ কোটি তারার আলো মিলেমিশে থাকে। এগুলি একেবারে প্রথম প্রজন্মের তারা বা নক্ষত্র। এরা যে সব পদার্থ দিয়ে গঠিত হয়েছিল আমাদের সূর্যের মতো দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের তারাগুলি সেই সব পদার্থ দিয়ে গড়া নয়। তাই এই আবিষ্কার সেই প্রথম প্রজন্মের তারারা কী কী পদার্থ দিয়ে গড়ে উঠেছিল সেই ইতিহাসও তুলে ধরবে আমাদের কাছে। তারাটিকে নিয়ে আরও অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সদ্য মহাকাশে পাঠানো আরও শক্তিশালী জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপকে’।
প্রাথমিক তথ্যাদি থেকে গবেষকদের অনুমান, মহাবিশ্বের এই প্রাচীনতম নক্ষত্রটি ৫০টি সূর্যের ভরের সমান। মহাবিশ্বের সবচেয়ে ভারী নক্ষত্রগুলির চেয়েও কোটি গুণ উজ্জ্বল। এই নক্ষত্রটির হদিশ মিলেছে যে ছায়াপথের ঝাঁকে তার নাম— ‘ডব্লিউএইচএলও১৩৭-০৮’।
মহাকাশ সব সময়েই চতুর্মাত্রিক। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা নিয়ে তার স্থান (স্পেস)। সঙ্গে রয়েছে সময় (টাইম)। স্পেস-টাইম তার চতুর্মাত্রিক। এই চতুর্মাত্রিক মহাবিশ্বে কোনও মহাজাগতিক বস্তুর টান থাকে আর একটি মহাজাগতিক বস্তুর উপর। একেই বলা হয় ‘গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স’ বা অভিকর্ষ বল। সেই বল আলোর পথও বাঁকিয়েচুরিয়ে দেয়।
মহাবিশ্বে খুব দূরে থাকা বস্তু মহাকাশে থাকা বিভিন্ন টেলিস্কোপের চোখে ধরা পড়ে ওই অভিকর্ষ বল আর তার জেরে আলোর পথ বেঁকেচুরে যাওয়ার ফলেই। তার ফলে, অনেক দূরের আলোও আমাদের চোখে ধরা দেয়। সামনে কোনও মহাজাগতিক বস্তু এসে পড়ে কাজ করে অনেকটা আতশকাচের মতো। দূরের আলোকে টেনে নিয়ে আসে কাছে। তাকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তোলে। খুব দূরে থাকা বস্তুরও আকার বাড়িয়ে দেয় বহু গুণ। জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে, ‘গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং’। এই ভাবেই হাব্লের চোখে ধরা দিল ইয়ারেন্ডেল।
হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপর ভাসমান অবস্থায় মহাকাশের নির্ভেজাল দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করছে৷ এমন কিছু ঘটনা সেটির চোখে পড়ছে, যা পৃথিবী থেকে দেখা অসম্ভব৷ মহাকাশের এই চোখ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের লুকানো সৌন্দর্য আমাদের চোখের নাগালে নিয়ে এসেছে এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে৷
অথচ দৃষ্টিশক্তির ত্রুটির কারণে এই মিশন প্রায় বানচাল হতে বসেছিল৷ এমন বিপর্যয়ের ফলে সেই টেলিস্কোপ দিয়ে শুধু অস্পষ্ট ছবি তোলা যাচ্ছিল৷ সৌভাগ্যবশত হাবল এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যে সেটির ভুলত্রুটি মেরামত করা সম্ভব৷ মোট পাঁচ বার মহাকাশে সেই টেলিস্কোপে নতুন যন্ত্রপাতি লাগানো হয়েছে৷
এর ফলে শুধু টেলিস্কোপের আয়ু বেড়ে যায়নি, মেরামতির কাজ চালানোর সুবাদে সেটি বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত টেলিস্কোপ হয়ে উঠেছে৷ ছবির মানও উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে৷ এই টেলিস্কোপের সাহায্যে জ্যোতির্বিদ্যার একাধিক ক্ষেত্রে যুগান্তকারী আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে৷
যেমন হাবল টেলিস্কোপের তোলা ছবি দেখে জানা গেছে, যে আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আরও দ্রুত গতিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে৷ এই আবিষ্কারের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১১ সালে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়৷ হাবলের কল্যাণেই জানা গেছে যে মহাকাশের বয়স ১,২০০ থেকে ১,৩০০ কোটি বছর৷
হাবলের আগে মহাকাশের এত গভীরে উঁকি মারা সম্ভব হয়নি৷ সেই জ্ঞানের কল্যাণে গ্যালাক্সির বিকাশ আরও ভালোভাবে বোঝা গেছে৷ হাবল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বেশিরভাগ গ্যালাক্সির মাঝের অংশে বিশাল ভরসম্পন্ন ব্ল্যাক হোল বাসা বেঁধে রয়েছে৷
নক্ষত্রের জন্ম ও বিকাশ সম্পর্কেও নতুন তথ্য দিয়েছে হাবল টেলিস্কোপ৷ মহাজাগতিক ধুলার আড়ালে নক্ষত্রের জন্মের বিস্তারিত দৃশ্যও দেখা গেছে৷ নক্ষত্রের মৃত্যু সম্পর্কেও অনেক কিছু জানা গেছে৷ হাবলের তোলা ছবি সাজিয়ে আলোড়নে ভরা সেই প্রক্রিয়া চাক্ষুষ করা সম্ভব হয়েছে৷ পরের দিকে হাবল দূরের নক্ষত্রজগতের মধ্যে গ্রহগুলিও পর্যবেক্ষণ করেছে৷ এমনকি সেগুলির বায়ুমণ্ডলও পরীক্ষা করেছে৷
সব কিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চললে মহাকাশে ভাসমান এই টেলিস্কোপ ২০২৫ সাল পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাবে এবং আরও অনেক বিস্ময়কর আবিষ্কার করবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩৫
আপনার মতামত জানানঃ