নারীদের জন্য পৃথিবীতে নরক হয়ে উঠেছে আফগানিস্তান। হত্যা, নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ, চাকরির সুযোগ হারানোর পর এবার বিক্রি করা হচ্ছে দাস হিসেবে। ১৯৯৬ সাল থেকেই আফগানিস্তানের নারীদের পথচলা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বেশি বন্ধুর। এক পা এগোলে দশ পা পিছিয়ে যেতে হয় তাদের। দেশের শাসনব্যবস্থা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় আফগান নারীর জীবনযাত্রা। চলার পথের প্রতিবন্ধকতাও বেড়ে যায়।
ক্ষমতা নেওয়ার পর নারীদের ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তালিবান। তবে নারীদের ওপর এবার অন্যরকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তালিবান।
আফগানিস্তানে তালিবান আত্মীয় পুরুষ সঙ্গী ছাড়া নারীদের বিমান ভ্রমণ বন্ধ করতে এয়ারলাইনগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিমান পরিবহন কর্মকর্তারা এ কথা জানিয়েছেন।
আফগানিস্তানের আরিয়ানা আফগান এয়ারলাইন এবং কাম এয়ারের দু’জন কর্মকর্তা রোববার জানান, তারা যেন একা ভ্রমণকারী নারীর বিমানে ওঠা বন্ধ করে দেয় সে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই দুই কর্মকর্তা আরো জানান, তালিবান প্রতিনিধি, এই দুটি এয়ারলাইন এবং বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের মধ্যে বৃহস্পতিবার বৈঠকের পর এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তালিবানের প্রতিক্রিয়ার ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাবুলের এয়ারলাইন্স কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কয়েকজন মহিলা শুক্রবার কাবুলের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে চড়তে এসেছিলেন। কর্তৃপক্ষ তাদের বলেছে, একজন পুরুষ অভিভাবক ছাড়া তাদের বিমানে ভ্রমণ করতে দেওয়া হবে না।
একজন কর্মকর্তার মতে, কয়েকজন মহিলা কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের দ্বৈত নাগরিক ছিলেন। কাম এয়ার এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আরিয়ানা এয়ারলাইন্সের ইসলামাবাদ, দুবাই এবং তুরস্কের ফ্লাইটে তাদের উঠতে দেওয়া হয়নি। বিমান কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়েছে, এ বিষয়ে তালিবান কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
আফগানিস্তানে তালিবান আত্মীয় পুরুষ সঙ্গী ছাড়া নারীদের বিমান ভ্রমণ বন্ধ করতে এয়ারলাইনগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এদিকে সর্বশেষ এই নিষেধাজ্ঞার আগে বুধবার তালেবান কর্তৃপক্ষ মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল ছাত্রীর স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর আফগানিস্তানে খুলেছিল মেয়েদের মাধ্যমিক স্কুল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলায় ক্লাসে ফিরেছিল মেয়ে শিক্ষার্থীরাও। কিন্তু বুধবার (২৩ মার্চ) স্কুল খোলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফের তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
২০ বছর পর গত ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান দখলে নেয় তালিবান। এরপর সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে তালিবান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার ঘোষণা দেয়। অবশ্য সরকার গঠন করলেও বিশ্বের কোনো দেশই এখনও পর্যন্ত তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। এর জেরে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ও এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থাও আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তাসহ অর্থ সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
অধিকাংশ দেশ তালিবান শাসনাধীন আফগানিস্তানকে স্বীকৃতি না দিলেও তারা বারবার মানবধিকার ও নারী অধিকারের বিষয়টি তুলেছে। তাদের অন্যতম দাবি ছিল, মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তালিবান সরকারের স্বীকৃতি এবং আফগানিস্তানকে ত্রাণসাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও নারী অধিকার ও শিক্ষার বিষয়টি তারা সামনে এনেছে।
এর আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আফগানিস্তান শাসন করেছে তালিবান। তখন তারা মেয়েদের শিক্ষা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। অধিকাংশ চাকরি মেয়েরা করতে পারত না।
এবার তালিবান আবার আফগানিস্তান শাসন করার পর মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা অনেক বেশি সংখ্যায় স্কুল ও কলেজে ফিরেছে। অবশ্য তালিবান বরাবরই বলছে, তারা নারীদের অধিকারকে সম্মান করে।
তবে এবার ক্ষমতায় এসে তালিবান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ইসলামি আইনের অধীনে তারা এবার নারীদের অধিকার নিশ্চিত করবে। যদিও সেটিতে এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না আফগান নারীরা।
এর মাঝেই তালিবান নির্দেশ দিয়েছে, নারীরা যেন আপাতত ঘরে থাকে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, নারীদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয়, তা অনেক তালিবান সদস্য এখনো জানে না। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরই নারীরা বাইরে কাজের সুযোগ পাবে। তবে এটাকে তালিবানের এক প্রকার কৌশল বলে মনে করছেন অনেকেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তালিবানের আফগান দখলের পর থেকেই দেশটিতে নারীদের অবস্থান নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। অত্যাচার নিপীড়নের পাশাপাশি বাড়ি থেকে কম বয়সী নারীদের জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া এমনকি মৃতদের ধর্ষণের অভিযোগও উঠেছে তালিবানের বিরুদ্ধে। আফগানিস্তানে নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রা থমকে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। কর্মজীবী নারীদের উপর নেমে আসছে নিয়মের খড়গ।
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর গত কয়েক মাসে পুরো পাল্টে গেছে দেশটির চেহারা। একের পর এক এলাকার দখলে নিয়েছে তালিবান। এরই মধ্যে আফগান নারী ও পুরুষের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। নারীরা বাড়ির বাইরে গেলে অবশ্যই তাদের বোরকা পরতে হবে। এ ছাড়া এ সময় তাদের সঙ্গে অবশ্যই একজন পুরুষ থাকতে হবে। ফলে নারীদের বাইরে চলাফেরা কঠিন হয়ে পড়েছে। ভয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন নারীরা।
তালিবান শরিয়া মোতাবেক নারী স্বাধীনতা দেওয়ার ঘোষণা দিলেও আফগান নারীদের আতঙ্ক কাটেনি। তারা বলছেন, তালিবানের অতীত শাসনে যেভাবে নারীদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় তারা।
আফগান নারী ও মেয়ে শিশুদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভাঙায় তালিবানের কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস।
অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘আফগান নারী ও মেয়ে শিশুদের দেওয়া তালিবানের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হতে দেখে আমি বিশেষ শঙ্কিত। আমি জোরালোভাবে তালিবানকে নারী ও মেয়ে শিশুদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং মানবিক আইনের বাধ্যবাধকতা মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছি।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪৬
আপনার মতামত জানানঃ