ইউক্রেনের মতো দেশের ক্ষেত্রে পশ্চিমারা যতটাই সরব বছরের পর বছর নির্যাতনের শিকার হয়ে আসা ফিলিস্তিন, ইয়েমেন কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বিষয়ে তারা ততটাই নিরব। এমনকি পাশ্চাত্য গণমাধ্যমের বিরুদ্ধেও বৈষম্যমূলক নীতির অভিযোগ করছেন অনেকে।
রুশ বাহিনীর আগ্রাসী আচরণের নিন্দায় সরব যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডার মতো দেশগুলো। সেসব দেশের মিডিয়াতে রীতিমতো ধুয়ে ফেলা হচ্ছে ভ্লাদিমির পুতিন ও তার বাহিনীকে। ভুক্তভোগী ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার ঝড় বইয়ে দিচ্ছে পশ্চিমারা। অথচ এই দেশগুলোই ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া যুদ্ধের ক্ষেত্রে চোখে যেন টিনের চশমা পরে থাকে।
আজ ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ রুশ আক্রমণ ঠেকাতে হাতে অস্ত্র তুলে নিলে তাদের ‘বীর মুক্তিকামী যোদ্ধা’ বলছে পশ্চিমারা, অথচ ফিলিস্তিনের মানুষ হাতে গুলতি ওঠালেও তা তাদের কাছে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ হয়ে যায়। ইউক্রেন যুদ্ধ যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, পশ্চিমারা কতটা ‘হিপোক্রেট’।
পশ্চিমাদের ‘দ্বিমুখী’ আচরণের জন্য তীব্র সমালোচনা করেছেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। রোববার আব্বাসের সঙ্গে দেখা করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। এ সময় তিনি এ সমালোচনা করেন। খবর মিডল ইস্ট আই-এর।
ব্লিনকেনকে পশ্চিমাদের তীব্র সমালোচনা করে আব্বাস বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর মস্কোকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ‘অপরাধ’ উপেক্ষা করছে পশ্চিমারা, যা ‘দ্বিমুখী’ আচরণ।
এক সংবাদ সম্মেলনে বৈঠকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইউরোপের বর্তমান ঘটনা নির্লজ্জ দ্বিমুখীতাকে সামনে এনেছে।
আব্বাস বলেন, ইসরায়েলি দখলদারদের জাতিগত নিধন এবং বৈষম্য সত্ত্বেও আমরা কাউকে খুঁজে পাইনি যারা দেশটিকে জাবাবদিহিতার আওতায় আনবে।
বৈঠকে ব্লিনকেন ফিলিস্তিনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার ইচ্ছার কথা জানান। এ সম্পর্ক সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের সময় একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল।
আব্বাস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে জানিয়েছেন ব্লিনকেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি এতদিন ছিল চীনের দিক থেকে আসা চ্যালেঞ্জের দিকে যা এখন সরে গেছে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে। এ সময়ের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে খুব একটা সময় খরচ করেনি ওয়াশিংটন।
এর মধ্যে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা না জানানোয় আব্বাসের প্রশাসন পশ্চিমা কূটনীতিকদের ক্ষুব্ধ করেছে।
পশ্চিমা কূটনীতিকদের একাধিক সূত্র এএফপিকে জানায়, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে রাশিয়ার হামলার নিন্দা জানানোর অনুরোধ নাকি জানানো হয়েছে।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের দোনবাস অঞ্চলে সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এর পর থেকে ইউক্রেনে হামলা চালাচ্ছে রুশ সেনারা। এর পর থেকে বেলারুশে কয়েক দফা ও তুরস্কে বৈঠক হলেও কোনো সমাধান আসেনি। কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্যেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পশ্চিমারা।
ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে গোটা বিশ্ব। হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া অধিকাংশ দেশই রাশিয়ার বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে। মস্কোর ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ কঠোর সব ব্যবস্থা নিচ্ছে তারা। বিশেষ করে ইউক্রেন ইস্যুতে ইউরোপ ও পশ্চিমা দেশগুলোর সক্রিয় ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে তাদের দ্বিমুখী নীতিও আলোচিত হচ্ছে সব খানে।
সমালোচকরা বলছেন, ইউক্রেন কিংবা তাদের মতাদর্শের দেশগুলোতে যে কোনো আগ্রাসনের বিষয়ে পশ্চিমারা যতটা সোচ্চার হয়েছে ঠিক ততটাই নির্বিকার থেকেছে ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আগ্রাসনের ক্ষেত্রে। ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলি আগ্রাসন কিংবা ইয়েমেন সৌদি জোটের মুহুর্মুহু হামলা সব ক্ষেত্রেই কেবল গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা জানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে দেশগুলো।
নিজেদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও ইরানকে পরমাণু অস্ত্র থেকে বিরত রাখতে চায় ইসরায়েল। নিরাপত্তার দোহায় দিয়ে ইরানকে পরমাণু মুক্ত রাখার বিষয়ে একমত পশ্চিমারাও। অন্যদিকে, রাশিয়ার চাওয়া ইউক্রেন যেন কখনোই ন্যাটোতে যোগ না দেয় কিংবা পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী না হয় এতে নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে রাশিয়া। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেনকে সার্বভৌম দেশ এবং তার নিজের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার রয়েছে উল্লেখ করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একাট্টা যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্ররা। সহজ ভাষায় পশ্চিমাদের এ ধরনের আচরণকে দ্বৈত নীতির সঙ্গে তুলনা করছেন সমালোচকরা।
পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর পাশাপাশি তাদের গণমাধ্যমের ভূমিকারও সমালোচনা চলছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য লড়াই করা মানুষদের সন্ত্রাসী আখ্যা দেয়া হলেও ইউক্রেনের নাগরিকদের যোদ্ধা আখ্যা দিচ্ছে গণমাধ্যম। এ ধরনের দ্বিমুখী আচরণেরও তীব্র সমালোচনা করছেন অনেকে।
বছরের পর বছর ধরে নিরীহ-নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের বর্বরোচিত আচরণের খবর পশ্চিমের প্রায় সব সংবাদমাধ্যমেই প্রচার হয়। তবে কিছুটা ভিন্নভাবে। তাদের ‘প্রচার স্টাইলে’ আগ্রাসনবাদীর শক্তি প্রয়োগ অনেকটাই আড়াল করে রাখা হয়। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে পশ্চিমা মিডিয়ার খবর ও নেতাদের কথাবার্তায় দখলদারি, গুলি করে হত্যা, গুলিবর্ষণ এবং বোমা হামলার মতো ঘটনাগুলোতে ‘ক্ল্যাশ’ (সংঘর্ষ), ‘কনফ্লিক্ট’ (সংঘাত) ও ‘প্রোপার্টি ডিসপুট’র (সম্পত্তি বিরোধ) মতো শব্দ ব্যবহার করতে দেখা যায়। এ ধরনের ‘প্যাসিভ ভয়েস’র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সহিংসতার ‘কারণ’ বা ‘টার্গেট’ চেপে যাওয়া হয়।
কিন্তু এখন ইউক্রেন সংঘাতের ক্ষেত্রে তারা ঠিকই ‘অ্যাগ্রেসন’ (আগ্রাসন), ‘ইনভেশন’ (আক্রমণ), ‘অ্যাটাক’ (হামলা), ‘কিল’ (হত্যা), ‘ইলিগ্যাল স্টেপ’ (অবৈধ পদক্ষেপ)-এর মতো শব্দ ব্যবহার করছে, যা ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও হওয়ার কথা ছিল। মজার বিষয় হচ্ছে, এতদিন ধরে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা, তাদের জমি কেড়ে নেওয়া সেই ইসরায়েলই আজ রাশিয়ার কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানাচ্ছে, তাদের শান্তি বজায় রাখতে বলছে।
এমনকি যে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার ‘আগ্রাসী আচরণে’ নিজেদের দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরে ঘণ্টায় ঘণ্টায় টুইটারে ভিডিওবার্তা দিচ্ছেন, সেই নেতাই গত বছর গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি দখলদারদের চালানো বর্বরোচিত হামলাকে এড়িয়ে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের পাল্টা জবাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। বলেছিলেন, ওই যুদ্ধে নাকি ইসরায়েলই ‘ভিকটিম’ (ভুক্তভোগী) ছিল।
২০২১ সালের ১০ মে থেকে ফিলিস্তিনে টানা বোমাবর্ষণ শুরু করে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী। তাদের আগ্রাসনের জবাবে গাজা থেকে রকেট হামলা চালায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠী হামাসও। টানা ১১ দিনের ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ২৬০ ফিলিস্তিনি নিহত হন, যাদের মধ্যে ৬৭ জনই ছিল কোমলমতি শিশু। আর ফিলিস্তিনি বাহিনীর পাল্টা হামলায় ইসরায়েলে প্রাণ হারান মোট ১২ জন।
সেই সময় গাজা উপত্যকায় অসংখ্যবার বিমান হামলা ও কয়েক হাজার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েলি বাহিনী। গুঁড়িয়ে দিয়েছিল কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) কার্যালয় ভবন। গাজায় নির্বিচারে ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে সোচ্চার হয় গোটা বিশ্ব। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগও আনে আন্তর্জাতিক মানবধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
অথচ সেই সময় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে না গিয়ে উল্টো ইসরায়েলিদের হয়ে কথা বলেছিলেন ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের পাল্টা হামলার নিন্দা জানিয়ে ইসরায়েলকেই ভুক্তভোগী বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
রুশ আক্রমণের মধ্যে ইউক্রেনীয়দের আরও একটি বিষয় সামনে আসছে, তা হলো ‘বর্ণবাদী আচরণ’। বিবিসি, আল-জাজিরাসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় খবর এসেছে, যুদ্ধের কারণে দেশত্যাগে আগ্রহীদের বেছে বেছে সীমান্ত পার করাচ্ছে ইউক্রেন। কৃষ্ণাঙ্গদের ট্রেনে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। ভারতীয় শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলার ভিডিও পর্যন্ত সামনে এসেছে।
যে ইউক্রেন বিদেশিদের সীমান্ত পার হতে বাধা দিচ্ছে, তারাই আবার নিজেদের রক্ষা করতে বিদেশিদের কাছেই বারবার আকুতি জানাচ্ছে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে পশ্চিমাদের কাছে। পশ্চিমারাও তাতে গলে যাচ্ছেন। সাদা চামড়া-নীল চোখের ইউক্রেনীয়দের জন্য মুখে মুখে হলেও প্রতিবাদের ঝড় তুলছেন তারা, যা ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, লিবিয়ার ক্ষেত্রে খুব একটা দেখা যায়নি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০০
আপনার মতামত জানানঃ