কার শাস্তি চাইব? বিচার নাই, বিচার কার কাছে চাইব— স্বাধীনতার ৫১ বছরে এসে কথাগুলো সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত সামিয়া আফরান জামালের বাবা জামাল উদ্দিনের। মেয়ে হত্যার বিচার চান না অসহায় বাবা।
রাজনৈতিক এই হত্যাকাণ্ডের সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে সামিয়ার বাবা বিচার না চাওয়া। সামিয়ার বাবা সবার সামনে দেশের প্রকৃত পরিস্থিতিকে আরও একবার তুলে ধরলেন। কার কাছে বিচার চাইবেন সামিয়ার বাবা, জানেন না। কারণ তিনি মনে করেন, দেশে ন্যায়বিচার নেই। বিচার চাইলে পাবেন তো না-ই, উল্টো নানা হয়রানির শঙ্কা থাকে। তাই বুকে পাথর চেপে তিনি মেয়ের মৃত্যুশোক বয়ে যাবেন। এভাবেই শোক বয়ে যাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি বা দিনদুপুরে পুরান ঢাকায় খুন হওয়া দরজি বিশ্বজিতের স্বজনেরা। সাংবাদিক সাগর-রুনির হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল ৭৯তম বারের মতো পিছিয়েছে। রুনির মা গত হয়েছেন কোনো বিচার না দেখেই।
দক্ষিণ-এশীয় রাষ্ট্রগুলো নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের উর্বর ভূমি। প্রতিহিংসার রাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ায় একটি অতি স্বাভাবিক বিষয় বলেই আমরা ধরে নেই।
বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টা। মতিঝিল এজিবি কলোনি থেকে মাইক্রোবাসে বাসায় ফিরছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু। শাহজাহানপুরের বাগিচার বাসায় সাদা রঙের মাইক্রোবাসে করে ফেরার সময় তিনি চালকের পাশের সিটে বসে ছিলেন। গাড়ি চালাচ্ছিলেন চালক মনির হোসেন মুন্না। পেছনের সিটে ছিলেন টিপুর ঘনিষ্ঠ দু’জন বন্ধু।
এজিবি কলোনি থেকে রওয়ানা দিয়ে মাত্র ৮ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে তারা পৌঁছান উত্তর শাহজাহানপুর বাটার দোকানের সামনে। ঢিল ছোড়া দূরত্বে খিলগাঁও রেলক্রসিং। ওই সময়টাতে ট্রেনের সিগন্যাল ছিল। তাই তারা যানজটে আটকা পড়েন। রাস্তার একপাশে যানবাহনের চাপ আর অন্য পাশ ফাঁকা। ঠিক তখনই ফাঁকা রাস্তায় উল্টোপথে লাল রঙের মোটরসাইকেল চালিয়ে আসে দুই সন্ত্রাসী। একজন অবস্থান করে মোটরসাইকেলে আর অপরজন রাস্তা পার হয়ে টিপুকে বহনকারী মাইক্রোবাসের সামনে গিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে।
ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। ১টি গুলি লাগে মাইক্রোবাসের চালক মুন্নার হাতে। আর এলোপাতাড়ি ছোড়া গুলিতে নিহত হয় আরেক নিরীহ রিকশা আরোহী সামিয়া আফরান জামাল প্রীতি।
গত ২৫ শে মার্চ দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিহত টিপু ও প্রীতির সুরতহাল সম্পন্ন হয়। এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি ফরেনসিক চিকিৎসক। দুপুর ২টার দিকে তাদের মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ ঘটনায় ওই দিন সকালে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে শাহজাহানপুর থানায় একটি মামলা করেছেন নিহত টিপুর স্ত্রী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি।
বাসায় ফেরা হলো না সামিয়ার
পশ্চিম শান্তিবাগের ভাড়া বাসায় মা-বাবা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে থাকতো রাজধানীর বদরুন্নেসা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফরান জামাল প্রীতি (২২)। গত কয়েকদিন ধরে সে খিলগাঁও তিলপাপাড়ার বান্ধবী সুমাইয়ার বাসায় ছিল। বৃহস্পতিবার তার বাসায় ফেরার কথা ছিল। সেজন্য রওয়ানাও দেয়। বাসার খুব কাছাকাছি চলেও গিয়েছিল। মা হোসনে আরা বেগম তখন তার মোবাইলে ফোন করে জানান চট্টগ্রাম থেকে প্রীতির মামা-মামী বাসায় বেড়াতে এসেছেন তাই সে যেন রাতটা বান্ধবীর বাসায়ই থাকে।
সামিয়া তখন বাসায় না গিয়ে তার বান্ধবী সুমাইয়াকে সবকিছু খুলে বলে। সুমাইয়া সম্মতি দেয়ার পর তাকে এগিয়ে নেয়ার কথা বলে। কথামতো সুমাইয়া তার কাছে আসে। পরে একটি রিকশা করে তিলপাপাড়ার উদ্দেশ্য রওয়ানা হয় তারা। তিলপাপাড়ার খুব কাছাকাছি গিয়ে তারা ট্রেন সিগন্যালে আটকা পড়ে। ঠিক তখন মাইক্রোবাসে করা এলোপাতাড়ি গুলি লেগে রিকশা থেকে পড়ে যায় প্রীতি।
আশেপাশের সবাই তখন বলতে থাকে তার গায়ে গুলি লেগেছে। তাকে উদ্ধার করে নেয়া হয় হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেন, প্রীতি মারা গেছেন। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! প্রীতি না যেতে পারলো নিজের বাসায়, না পারলো বান্ধবীর বাসায়। অথচ দু’টি বাসারই খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল প্রীতি।
সামিয়ার বান্ধবী সুমাইয়া বলেছে, রিকশায় ওঠার পরপরই হঠাৎ শব্দ শুনি। ২ জনই রিকশা থেকে পড়ে যাই। প্রীতির গায়ে রক্ত দেখে আশেপাশের লোকজন বলেন, তার গুলি লেগেছে। মেডিকেলে আসার পর মৃত ঘোষণা করা সামিয়াকে। সে বলেছে, প্রীতি বদরুন্নেসা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। খিলগাঁওয়ের একটি দোকানে দেড় মাস কাজ করেছিল। কিছুদিন করার পর চাকরি ছেড়ে দেয়। বর্তমানে বেকার ছিল।
বিচার চাইবো কার কাছে
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিহত সামিয়ার বাবা জামাল উদ্দিন বলেন, কুমিল্লার মুরাদনগরে তাদের বাড়ি। তিনি মিরপুরের ছোট একটি কারখানায় চাকরি করেন। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ভাতা থেকে যা পেতেন তা দিয়েই সংসার চালাতেন। ইচ্ছা ছিল মেয়ে বড় হয়েছে চাকরি বাকরি করে সংসারে কিছুটা সহযোগিতা করবে। কিন্তু তা আর হলো না। ছেলেটাও মাত্র এসএসসি পরীক্ষার্থী। কথাগুলো বলে আহাজারি করছিলেন তিনি।
মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে মামলা করবেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মেয়ে হত্যার বিচার কার কাছে চাইবো। বিচার করার মালিক একজন আল্লাহ। এখন বিশ্বে তো কোনো বিচার নেই। বিচার বলতে কিছু আছে? কোনো দেশেই ভালো বিচার নেই।
তিনি বলেন, বিচার চেয়ে লাভ নেই। নিরীহ মানুষ আমরা। সাধারণ জীবন যাপন করি। আমরা মুক্তিযোদ্ধার পরিবার। ভালো থাকার চেষ্টা করি। বিচার চাওয়ার কিছু নেই। যার কাছে চাওয়ার, তার কাছেই চাইতে হয়। মানুষের কাছে কি চাইবো। আল্লাহ যেন মানুষকে হেদায়েত দেন, শান্তি দেন।
তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে প্রীতির ফোন থেকে পুলিশ ফোন দিয়ে জানান দুর্ঘটনা ঘটেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসতে হবে। আমরা ১২টার দিকে আসি। আসার পর এই দুর্ঘটনার কথা শুনি। সামিয়ার ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকার বাসায় নিয়ে যাবেন বলে জানান জামাল উদ্দিন। সেখানে সন্ধ্যায় জানাজা শেষে শাহজাহানপুর কবরস্থানে দাফন করা হবে। পুলিশ জানিয়েছে, সামিয়ার পিঠে গুলি লেগেছে।
কেন এই হত্যাকাণ্ড
অনুসন্ধান ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, মতিঝিল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন টিপু। ১০ বছর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ সময়টাতে তার যেমন অনুসারী ছিলেন ঠিক তেমনি তার শত্রুর সংখ্যাও কম ছিল না।
রাজনীতির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন ব্যবসাবাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। হোটেল ব্যবসা, ফার্মেসি ব্যবসা ও ঠিকাদারি করতেন। বাংলাদেশ ক্রীড়া পরিষদ ঠিকাদার সমিতির সভাপতিও ছিলেন। এছাড়া মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন পাঁচ বার। দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কোন্দল ছিল।
তথ্য মতে, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুনোখুনির ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। ২০১৩ সালের ২৯শে জুলাই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তৎকালীন দক্ষিণ যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কিকে খুন করা হয়। ওই মামলার আসামি ছিলেন টিপু। এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলও খেটেছেন টিপু। পরে জামিনে মুক্ত হন। মামলার এজাহারে নাম থাকলেও তদন্তে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, টিপু হত্যার পেছনে বেশ কিছু কারণ সামনে উঠে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রথমত রাজনৈতিক কোন্দল। টিপুর স্ত্রী মামলার এজাহারেও বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, মতিঝিল আইডিয়ালের গভর্নিং বডির সদস্য হয়ে ভর্তিবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, মতিঝিলের বিভিন্ন এলাকায় দোকানপাট বসিয়ে দখলদারি নিয়ন্ত্রণ করার মতো বিষয়ও আলোচনায় আছে।
সূত্র মতে, টিপুর একক আধিপত্য নিয়ে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছিল দীর্ঘদিন ধরে। টিপুকে বারবার নিয়ন্ত্রণ ছাড়ার জন্য বলা হয়। কিন্তু তা করেননি টিপু। এজন্য মোবাইলে হুমকিও দেয় দুর্বৃত্তরা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, টিপু হত্যাকাণ্ডে যে খুনি অংশগ্রহণ করেছে সে একজন পেশাদার খুনি। এবং অস্ত্র চালনায় পারদর্শী। এত কম সময়ে প্রকাশ্য এতগুলো গুলি করে পালিয়ে যাওয়া সবার পক্ষে সম্ভব না। পাকা হাতের কাজ এটা। চুক্তিভিত্তিক এই পেশাদার খুনিকে বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে চুক্তি হয়েছে। তাই ধারণা করা হচ্ছে টিপু হত্যা ছোটখাটো কোনো বিষয় নিয়ে হয়নি। এর পেছনে বড় ধরনের কিছু থাকতে পারে। এজন্য একাধিক ক্লু নিয়েই তদন্ত করা হচ্ছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
পুলিশের মতিঝিল ডিভিশনের উপ-পুলিশ কমিশনার আবদুল আহাদ বলেন, ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত। আমরা বেশকিছু ক্লু পেয়েছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। তার স্ত্রী রাজনৈতিক কোন্দল ও মোবাইলে হত্যার হুমকির বিষয় উল্লেখ করেছেন। আমরা এসব বিষয় খতিয়ে দেখছি।
শুক্রবার কাওরানবাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ঘটনাস্থল থেকে আমরা কিছু আলামত উদ্ধার করেছি। আমাদের তদন্তে কিছুটা অগ্রগতি আছে। আমরা ঘটনার বেশকিছু ফুটপ্রিন্ট, তথ্য ও আলামত পেয়েছি। বেশকিছু মোটিভ পেয়েছি। যে শুটার, তাকেও আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজের মাধ্যমে শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ