জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরম বিপদের মুখে পড়েছে গোটা বিশ্ব! নানারকম পরিবর্তন হতে শুরু করেছে আবহাওয়ায়। সেই পরিবর্তনের ঢেউ এসে লেগেছে মানুষ ছাড়াও জীবজগতের অন্য প্রাণীকুলের উপরেও। তার মধ্যে অন্যতম পাখি।
বসন্তের আগমন একটি বড় উৎসব। এসময় দিনগুলো দীর্ঘ হয়, গাছপালা ফুলে ফুলে ভরে যায় এবং মৌমাছির কর্মকাণ্ডও বেড়ে যায়। কিন্তু জলবায়ু সংকটের কারণে বসন্তের শুরুর এই দিনগুলোতে বেশ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। গবেষণা বলছে, এক শতাব্দী আগের তুলনায় পাখির অনেক প্রজাতি এখন এক মাসে আগে বাসা বাঁধছে এবং ডিম পাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা শিকাগো অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা ডিমের নমুনা থেকে বাসা বাঁধার ধারা বিশ্লেষণ করেন। তারা ৭২টি নমুনা সংগ্রহ করেন, তার এক তৃতীয়াংশ আগের তুলনায় প্রতি বছরই এক মাস আগেই বাসা বাঁধা শুরু করেছে।
জেস, ইয়েলো ওয়ার্বলারস এবং ফিল্ড স্প্যারোসহ এসব প্রজাতি ১০০ বছর আগে যে সময়ে ডিম বসাতো তার তুলনায় এখন গড়ে ২৫ দিন আগেই ডিম বসাচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর কারণে পরিবেশে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াতেই পরিস্থিতির এমন পরিবর্তন হয়েছে যেটা দীর্ঘকাল অপরিবর্তনীয় ছিল।
ফিল্ড মিউজিয়ামের পাখিদের কিউরেটর এবং এই গবেষণার মূল লেখক জন বেটস বলেন, এমন তথ্য খুবই হতবাক করার মতো। এমন ঘটনা নিশ্চিত ইঙ্গিত দেয় যে, জলবায়ু পরিবর্তনের তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব পড়েছে পাখিদের আচরণের উপরও। জলবায়ুর প্রভাব বিষয়ে আমরা যতগুলো গোলকধাঁধায় পড়েছি, তার একটি এটি।
এনিমেল ইকোলজি জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণাটি ১৮৮০ থেকে ১৯২০ সালে সংগ্রহ করা ডিমের তথ্যের ভিত্তিতে করা। ডিম সংগ্রহ করার ওই সব বক্সে হাতে লেখা লেবেল থাকতো। যেখানে পাখির ধরন এবং কখন এসব ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল সেসব উল্লেখ থাকতো। সেই সব তথ্যের সঙ্গে বেটসের সহকর্মী বিল স্ট্রসবার্গার এবং শিকাগোর ইলিনয়েস ইউনিভার্সিটির বিবর্তনীয় পরিবেশবিদ ক্রিস হেলানের আধুনিক বাসা বাঁধার তথ্যগুলোর তুলনা করে এমন ফলাফল পাওয়া যায়।
এ সমস্ত কিছুর নেপথ্যে রয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং। তার ফলেই জলবায়ুর এ হেন ঘনঘন পরিবর্তন। যা রীতিমত চিন্তায় ফেলে দিয়েছে বিজ্ঞানীদের। এছাড়া তাদের চিন্তায় রাখছে আরও একটি কারণ। মোর্নিং ডাভ, আমেরিকান কেস্ট্রেল এবং কুপার্স হক ইত্যাদি পাখিগুলি সময়ের আগে ডিম পাড়ছে। কিন্তু এদের মধ্যে পরিযায়ী অবস্থা বা আকার এমন কোনও বৈশিষ্ট্য এখনও দেখতে পাননি বিজ্ঞানীরা। ফলে এটা পরিষ্কার হচ্ছে না, কেন ডিম পাড়ার সময় পরিবর্তন করেছে পাখিগুলি।
জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর কারণে পরিবেশে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াতেই পরিস্থিতির এমন পরিবর্তন হয়েছে যেটা দীর্ঘকাল অপরিবর্তনীয় ছিল।
এদিকে গত বছর সেপ্টেম্বরে দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিজ্ঞানীরা বলছেন, ক্রমবর্ধমান জলবায়ু সংকটের কারণে প্রাণীরা প্রতিনিয়ত তাদের ‘আকার পরিবর্তন’ করছে।
বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধানে জেনেছেন, উষ্ণ রক্তের প্রাণীরা তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য (ফিজিওলজি) পরিবর্তন করে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের চক্ষু, পা এবং কান প্রসারিত হচ্ছে।
এ ছাড়া দেহ অতিরিক্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠলে পাখিরা তাদের ঠোঁট এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীরা কান ব্যবহার করে সে তাপ বিকিরণ করে বা ছড়িয়ে দেয়। তবে যদি প্রাণীরা তাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে অতিরিক্ত গরমে তারা মারাও যেতে পারে।
ট্রেন্ডস ইন ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশন জার্নালে সমীক্ষা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পাখিদের মধ্যে পার্থক্যগুলো বিশেষ প্রকট। গবেষণার লেখক এবং ডেকিন ইউনিভার্সিটির পক্ষী গবেষক সারা রাইডিং বলেন, আকৃতি পরিবর্তন হচ্ছে এর অর্থ এই নয় যে, প্রাণীরা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে বরং ব্যাপারটি মোটেও স্বাভাবিক নয়।
এর মানে হলো এই যে, তারা বেঁচে থাকার জন্য এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা নিশ্চিত নই যে এই পরিবর্তনের অন্যান্য পরিবেশগত পরিণতি কী হবে, কিংবা সব প্রজাতিই এভাবে অভিযোজিত হয়ে বেঁচে থাকতে পারবে কি না।
রাইডিং বলছেন, যেভাবে আমাদের গ্রহটি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে তাতে অচিরেই এসব পরিবর্তন আর নগণ্য হিসেবে থাকবে না। এখন যেসব পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তা সব মিলিয়ে ১০ শতাংশেরও কম হবে। ফলে চট করে এসব পরিবর্তন চোখে পড়ে না।
কিন্তু এভাবে যদি প্রাণীদের কান বড় হতে থাকে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আমরা বাস্তবেই হয়তো ডাম্বোকে (ওয়াল্ট ডিজনি প্রোডাকশনের একটি কাল্পনিক/এনিমেটেড চরিত্র) দেখতে পাব।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে এখন বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে বসন্ত তাড়াতাড়ি আসে এবং শরৎ অনেক জায়গায় দেরিতে আসে, ফলে প্রাণী ও গাছপালাগুলো একই হারে অভিযোজিত হচ্ছে না।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, প্রজাতিগুলো যদি একে অপরের সমন্বয়ের বাইরে চলে যায়, তবে তা বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিকে ‘ইকোলজিক্যাল মিসম্যাচ’ বলা হয়ে থাকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি যেমন পরিবেশগত, তেমনি একই সঙ্গে তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকও বটে। উন্নত দেশগুলোর কারণেই এই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, ফলে তাদের কার্বন উদ্গিরণ হ্রাসে বাধ্য করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা, কার্যকর কূটনীতি ও রাজনীতি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০০
আপনার মতামত জানানঃ