বায়ুদূষণের দিক থেকে গত কয়েক বছরের মতো এবারও বিশ্বের শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকাও বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে বরাবরের মতোই শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। রাজধানীর বাতাসকে বিষিয়ে তোলার জন্য সবেচয়ে বেশি (৩০%) দায় অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজের।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) ২০২১ সালের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়, রাজধানীর বাতাসকে বিষিয়ে তোলার জন্য সবেচয়ে বেশি (৩০%) দায় অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজের। ২৯% দূষণের উৎস ইটভাটা ও শিল্পকারখানা। অন্যান্য উৎসের মধ্যে যানবাহনের কালো ধোঁয়া (১৫%), আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ (১০%), গৃহস্থালি ও রান্নার চুলা থেকে নির্গত দূষণ (৯%) এবং বর্জ্য পোড়ানোর কারণে (৭%) বায়ুদূষণ হয়ে থাকে।
ক্যাপস গবেষণায় পেয়েছে, রাজধানীর বায়ুদূষণের উৎসের একটি বড় বদল ঘটে গেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ২০১২ সালের জরিপ অনুযায়ী ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎস ছিল ইটভাটা (৫৮%)। এর এক যুগ পর ২০২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে বায়ুদূষণের মূল উৎস বলা হয় যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়াকে (৫০%)। কিন্তু মাত্র এক বছরের মাথায় গতকাল প্রকাশিত ক্যাপসের গবেষণা বলছে, ঢাকার বাতাসে দূষিত বস্তুর উৎস হিসেবে ইটভাটা এবং যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়ার স্থান দখল করেছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি আর নির্মাণ কাজ।
এক পাশে সম্প্রসারণের কাজ চলছে। অন্য পাশে খোঁড়া হচ্ছে নালা। খোলা জায়গায় ফেলে রাখা হয়েছে বালু ও সুরকি। রাস্তায় ধুলাবালুর স্তর। তা যানবাহন গেলেই বাতাসে উড়ছে। সঙ্গে গাড়ির কালো ধোঁয়া তো রয়েছেই।
এ চিত্র ঢাকার বিভিন্ন স্থানেই দেখা মেলে। অথচ ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্ট বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তার মধ্যে নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, পানি ছিটানো এবং খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে দরপত্রের শর্ত মানার বিষয়গুলো ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের ঠিক কাছেই নির্দেশনাগুলো মানা হচ্ছে না।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত থেকে ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর এবং ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে ৯টি নির্দেশনা দেওয়া হয়। যার মধ্যে রয়েছে ঢাকা শহরে মাটি, বালু বা বর্জ্য পরিবহন করা ট্রাক ও অন্যান্য গাড়িতে মালামাল ঢেকে রাখা; নির্মাণকাজ চলা এলাকায় মাটি, বালু, সিমেন্ট, পাথর ঢেকে রাখা; সিটি করপোরেশন রাস্তায় নিয়মিত পানি ছিটাবে; রাস্তা, কালভার্ট, কার্পেটিং, খোঁড়াখুঁড়ির কাজে দরপত্রের শর্ত পালন নিশ্চিত করতে হবে; সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে গাড়ির চলাচল সময়সীমা নির্ধারণ ও সময়সীমার পরে গাড়ি চলাচল বন্ধ করা; পরিবেশগত সনদ ছাড়া চলমান টায়ার ফ্যাক্টরি বন্ধ করা; বিপণিবিতান অথবা দোকানের প্রতিদিনের বর্জ্য ব্যাগে ভরে রাখা ও বর্জ্য অপসারণ নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনের পদক্ষেপ নেওয়া।
এ নির্দেশনাগুলো দেওয়ার পর ২০২০ সালের নভেম্বরে আদালত তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দূষণের শীর্ষে থাকা অন্য রাজধানী শহরগুলোর ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বিষয়সহ নানান কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানীর ক্ষেত্রে মূল কারণ সরকারি সংস্থাগুলোর অবহেলা, গাফিলতি ও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণটি সরকারের অগ্রাধিকারে না থাকা।
সব মিলিয়ে ২০২০ সালের মতো ২০২১ সালেও সুইজারল্যান্ডের দূষণরোধকারী প্রযুক্তি সেবাদাতা সংস্থা আইকিউএয়ারের ‘বিশ্ব বায়ুমান প্রতিবেদন-২০২১’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থানে কোনো নড়চড় হয়নি। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশের বায়ু বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত। আর রাজধানী শহরের মধ্যে ভারতের দিল্লির পর দ্বিতীয় অবস্থানে ঢাকা। এরপর রয়েছে আফ্রিকার দেশ চাদের রাজধানী এনজামেনা, তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবে এবং ওমানের রাজধানী মাসকাট।
বায়ুদূষণ নিয়ে প্রশ্ন করা হলেই সরকারি সংস্থাগুলো নগরজুড়ে চলা উন্নয়নকাজকে দায়ী করে। তাদের বক্তব্য হলো, অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য এ অসুবিধাটুকু মানুষকে মেনে নিতে হবে।
দূষণের শীর্ষে থাকা অন্য রাজধানী শহরগুলোর ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বিষয়সহ নানান কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানীর ক্ষেত্রে মূল কারণ সরকারি সংস্থাগুলোর অবহেলা, গাফিলতি ও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণটি সরকারের অগ্রাধিকারে না থাকা।
যেমন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেসব এলাকায় বায়ুদূষণ বেশি, সেখানে উন্নয়নকাজ বেশি হচ্ছে। অবকাঠামো নির্মাণ, মেরামতসহ এসব কাজে ধুলা বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে আমরা বসে নেই। ধুলাদূষণ বন্ধে আমরা রাস্তায় পানি ছিটানোর জন্য আলাদা গাড়ি কিনেছি। নিয়মিতভাবে এসব গাড়ি দিয়ে পানি ছিটানো হচ্ছে।’
অবশ্য মেয়রের দাবিকে আংশিক সঠিক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, উন্নয়নকাজ হলে ধুলা হবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সরকারি প্রকল্পে সেটা হয় না। কোনো ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তা লোকদেখানো। যদিও প্রকল্পে ধুলাদূষণের নিয়ন্ত্রণে অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়।
নগর–পরিকল্পনাবিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ধানমন্ডি এলাকায় থাকি। সেখানে কোনো নির্মাণকাজ চলছে না। সেখানেও ধুলা এসে ঘরে ঢুকছে। আমি নিজেও কাশিসহ নানা সমস্যায় ভুগছি।’ তিনি বলেন, ঢাকার মেট্রোরেল থেকে শুরু করে উড়ালসড়ক—বেশির ভাগ প্রকল্প খুব অদক্ষতার সঙ্গে হচ্ছে। এখানে বেসরকারি খাতের নির্মাণকাজেও বিধি মানা হয় না। সব মিলিয়ে ঢাকা দূষণে শীর্ষে উঠেছে।
একটা সময় ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য দায়ী করা হতো ইটভাটার ধোঁয়াকে। সেই জায়গা পরে দখল করে নেয় মোটরযান ও শিল্পকলকারখানার ধোঁয়া। এখন কয়েক বছর ধরে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প ও ছোট–বড় আবাসন প্রকল্পের উন্মুক্ত পরিবেশে অনিয়ন্ত্রিতভাবে নির্মাণযজ্ঞ বাড়িয়েছে ধুলাদূষণ। ফলে কোথাও কোথাও স্বাভাবিকের তুলনায় ১০ গুণ বেশি ধুলার সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গত বছর পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বায়ুদূষণ রোধে যে নির্দেশিকা দিয়েছিল, সেটির তেমন বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। নির্দেশিকায় রাস্তা নির্মাণের সময় নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, বিটুমিনের ওপর বালু না ছিটিয়ে মিনি অ্যাসফল্ট প্ল্যান্টের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, রাস্তার পাশের মাটি কংক্রিট বা ঘাসে ঢেকে দেওয়া, রাস্তা পরিষ্কারের ঝাড়ুর পরিবর্তে ভ্যাকুয়াম সুইপিং ট্রাক ব্যবহার, বড় সড়কে কমপক্ষে দুবার পানি ছিটানোর কথা বলা হয়েছিল। এর কোনোটি কার্যকর করার উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। এর আগেও এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তখনো সে অনুযায়ী কিছু হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরবাসীর কাছে যানজটের পাশাপাশি আরেক যন্ত্রণার নাম বায়ুদূষণ। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কবলে নগরজীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। বাড়িয়ে তুলছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু, বৃদ্ধ ও শ্বাসতন্ত্রের রোগীরা।
প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণে ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতা কমে শ্বাসকষ্ট ক্রমাগত বাড়ে বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, প্রথমে শ্বাসনালি ও চোখে সমস্যা তৈরি করে। ফলে অ্যাজমা ও নিউমোনিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এ দূষিত বায়ু গ্রহণ ব্রঙ্কাইটিস থেকে ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করেন। এদিকে বায়ুদূষণের কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বেশি দেখা দেয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
এ জন্য বায়ুদূষণের সঙ্গে মানুষের গড় আয়ুর বিষয়টি জড়িত। আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে কিন্তু সেটা কতটা মানসম্মত সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত। আমাদের জীবদ্দশায় কতটা সময় হাসপাতালে কাটাতে হয়, সেটাও হিসাব করা উচিত বলে জানান তারা।
নির্মল বায়ুর জন্য স্থায়ী কোনো নীতি যেটি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে পারে, সেটা গড় আয়ু বাড়ানোর পাশাপাশি জলবায়ুর ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তারা এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে চীনকে উল্লেখ করে বলেছেন, ২০১১ সালের তারা যে নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে তাদের গড় আয়ু বেড়েছে ২.৬ বছর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছয় ধরনের পদার্থ এবং গ্যাসের কারণে ঢাকায় দূষণের মাত্রা সম্প্রতি অনেক বেড়ে গেছে। এরমধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা অর্থাৎ পিএম ২ দশমিক ৫-এর কারণেই ঢাকায় দূষণ অতিমাত্রায় বেড়ে গেলেই পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠছে। ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে গর্ভবতীদের বিরাট স্বাস্থ্য ঝুকির মধ্যে থাকতে হয়। অতিমাত্রায় বায়ুদূষণের কারণে অনেকক্ষেত্রে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার যানবাহনের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণের কাজটি মূলত সরকারি সংস্থাগুলোর। আর ধোঁয়া ও ধুলা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও সিটি করপোরেশনগুলো থেকে নিয়মিত তদারকি এবং রাস্তায় পানি ছিটানোর কাজ করলেই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। কিন্তু এ নিয়মিত কাজটিও ঠিকমতো না করায় বায়ুদূষণ পরিস্থিতির বেশি অবনতি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকার পরিবেশ সুরক্ষায় সরকারের সংস্থাগুলোর সমন্বিত কার্যক্রমের বিকল্প নেই। এ জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে কার্যকর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৫
আপনার মতামত জানানঃ