১৯৪১ সালে জার্মানির হিটলার রাশিয়া দখলের চেষ্টা করে যে মারাত্মক ভুল করেছিল ঠিক তার ১৩০ বছর এর কাছাকাছি সময় আগে আরেক বিশ্ব বিখ্যাত বরেণ্য যোদ্ধা নেপোলিয়ন বোনাপোর্ট রাশিয়া দখল করতে চেয়ে আরেক চরম ভুলের সূচনা করেছিলেন।
নেপোলিয়ন ও হিটলার দুইজনই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, রাশিয়া দখল করার চেষ্টা করার মূল্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে। যে দেশের শীত হল যুদ্ধে ফার্স্ট জেনারেলের ভূমিকা পালন করে। আজকে আমরা নেপোলিয়নের রুশ বা মস্কো অভিযান সম্বন্ধে জানবো। এই অভিযানের ফলেই নেপলিয়নের প্রবল কর্তৃত্ব খর্ব হয়েছিল এবং যা আস্তে আস্তে নেপোলিয়নের ধ্বংস ডেকে এনেছিল।
অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার(বর্তমান জার্মানির অংশ) পর ইউরোপে স্থল শক্তির মধ্যে একমাত্র রাশিয়া সঙ্গে নেপলিয়নের শক্তি পরীক্ষা বাকী ছিল। ১৮০৭ সালে আইলাউ এবং ফ্রিডল্যান্ডের যুদ্ধে নেপোলিয়ন রাশিয়ার জার আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। এতে রাশিয়ার জার আলেকজান্ডার নেপলিয়নের সাথে চুক্তি করতে বাধ্য হন। এতে ইউরোপের রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন আনে।
১৮০৭ সালে স্বাক্ষরিত টিলসিটের চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়া ফ্রান্সের বন্ধুতে পরিণত হয়। কিন্তু এই চুক্তির ভিত্তি ছিল খুবই দুর্বল। ফলে খুব অল্পতেই বিভিন্ন কারণে তাদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়ন শুরু হয়। এই চুক্তিতে ফ্রান্স রাশিয়াকে তুরস্কের বিরুদ্ধে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে তা ভঙ্গ করে নেপোলিয়ন। ফলে রাশিয়ার জার আলেকজান্ডার খুবই ক্ষুদ্ধ হন।
১৮১০ সালে নেপোলিয়ন চুক্তি ভঙ্গ করে জার আলেকজান্ডার এর ভাগ্নিপতি ডিউক এর ওন্ডেনবার্গ দখল করেন। স্বাভাবিকভাবেই জার আলেকজান্ডার এতে খুশি হতে পারেননি। ইতিমধ্যেই নেপোলিয়ন আগ্রাসী হয়ে পোলান্ডের গ্যালিশিয়া দখল করে এই অঞ্চল নিয়ে “গ্রান্ড ডাচি অব ওয়ারস” নামক রাজ্য গঠন করেন। ফলে নেপোলিয়ন এই অঞ্চলে কয়েক লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করে পোলান্ডকে ফরাসি উপনিবেশে পরিণত হয়।
নেপোলিয়নের এই পদক্ষেপে জার আলেকজান্ডার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন যে পোল্যান্ড ভাগ করে যে অংশ রাশিয়া পায় তা হারাবার অবস্থা তৈরি হতে পারে। ফলে জার আলেকজান্ডার নেপোলিয়নের কাছে এই দাবি করেন যে, তিনি ভবিষ্যতে স্বাধীন পোল্যান্ড এর দাবী করবেন না। কিন্তু নেপোলিয়ন তাতে রাজি হননি। ফলে দুই দেশের সম্পর্ক আরো খারাপ হতে থাকে।
ইংল্যান্ডকে ধ্বংস করতে নেপোলিয়ন যে বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ করে মহাদেশীয় ব্যবস্থা চালু করেন তাতে জার আলেকজান্ডারও সম্মতি দিয়েছিলেন কিন্তু যখন ইউরোপীয় অন্যান্য দেশের মতো রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থায় প্রায় ধ্বংসের পথে তখন জার আলেকজান্ডার মহাদেশীয় ব্যবস্থা মেনে চলতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে রাশিয়া নেপোলিয়নের বিরাগভাজনে পরিণত হন।
১৮১২ সালে নেপোলিয়ন প্রায় ছয় লক্ষ সৈন্য নিয়ে মস্কো অভিযান শুরু করেন। নেপোলিয়নের পরিকল্পনা ছিল যে, তিনি সম্মুখ যুদ্ধে রুশ বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিবেন। কিন্তু জারের চতুর সেনাপতি কুটুফজ সম্মুখ যুদ্ধ এড়িয়ে পশ্চাদপসরণ নীতি অনুসরণ করেন।
১৮১২ সালে নেপোলিয়ন প্রায় বিনা বাধায় রাশিয়ার ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েন। স্মলেনস্কে ঢুকে অনেকটা জনমানবহীন রাশিয়াকে আবিষ্কার করে নেপোলিয়ন। ইতোমধ্যে খাদ্যাভাব ও প্রচণ্ড শীতে নেপোলিয়নের এক লক্ষ সৈন্য মারা যায়। নেপোলিয়নের উচিত ছিল স্মলেনস্কতে অবস্থান করে শীতকাল অতিবাহিত করে পরে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের দিক অগ্রসর হওয়া।
কিন্তু নেপোলিয়ন তা না করে বরং জার আলেকজান্ডারকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করার জন্য মস্কো অগ্রসর হন। কিন্তু রাশিয়ানগণ পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে তাদের রাজধানী জনশূন্য ও বিধ্বস্ত অবস্থায় রেখে পশ্চাদপসরণ করেন।
১৮১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মস্কোর কাছাকাছি বোরডিনোর রণাঙ্গনে রাশিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। যদিও যুদ্ধে নেপোলিয়ন জয়লাভ করেছিল কিন্তু তাতে তার সৈন্য ও রসদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ফরাসী বাহিনী মস্কো দখল করে আগুন লাগিয়ে দেয়।
নেপোলিয়ন আশা করেছিলেন যে এতে হয়ত জার আলেকজান্ডার নরম হয়ে নেপোলিয়নের পায়ে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা চাইবেন ও শান্তিচুক্তির পথে ধাবিত হবেন। কিন্তু নেপোলিয়নের সেই আশা পূরণ হয়নি। এদিকে প্রচণ্ড খাদ্যাভাবে ও ভয়াবহ শীতে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী এক চরম অবস্থায় পতিত হয় এবং বহু সৈন্য মারা যায়।
এদিকে রুশ সেনাদের গেরিলা কায়দায় পালটা হানায় বহু ক্ষুধার্ত ও রুগ্ন সেনা হতাহত হয়। শেষ পর্যন্ত নেপোলিয়ন ৬ লক্ষ সেনার মধ্যে মাত্র ৫০,০০০ হাজার সৈন্য নিয়ে দেশে ফিরতে সক্ষম হয়েছিলেন। এভাবেই নেপোলিয়নের মস্কো অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৩৫
আপনার মতামত জানানঃ