চরম অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের মধ্যদিয়ে চলছে সরকারি মালিকানাধীন দেশের একমাত্র লাইফ ইন্স্যুরেন্স জীবন বীমা কর্পোরেশন। প্রতিষ্ঠানটি বছরের পর বছর ধরে আইন লঙ্ঘন করে গ্রাহকদের টাকা মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় করছে।
এছাড়া অস্তিত্বহীন এজেন্টের নামে খরচ করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। ফলে ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে প্রিমিয়াম আয়। এমনকি গ্রাহকের কাছে বিক্রি করা অর্ধেক পলিসি বছর ঘুরতেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গ্রাহকের বিমা দাবির টাকা পরিশোধেও টালবাহানা করছে কোম্পানিটি।
অভিযোগ রয়েছে, সর্বশেষ ২০২১ সালে কোম্পানিটি আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা ব্যয় হিসেবে অতিরিক্ত খরচ করেছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। বছরের পর বছর ধরে কোম্পানিটি এভাবে অবৈধ ব্যয় করছে।
এমন অবৈধ ব্যয়ের কারণে পলিসি গ্রাহকরা বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের প্রাপ্য বোনাস থেকে। একই সঙ্গে লভ্যাংশ থেকে সরকারও বঞ্চিত হচ্ছে। আর উপযুক্ত বোনাস দিতে না পারায় গ্রাহকের আস্থা হারাচ্ছে এই সরকারি বিমা প্রতিষ্ঠানটি।
গ্রাহকদের টাকা অবৈধভাবে ব্যয় করার পাশাপাশি কোম্পানিটির বিরুদ্ধে সঠিকভাবে বিমা দাবির টাকা পরিশোধ না করার অভিযোগও রয়েছে। সেই সঙ্গে প্রতিবছর কোম্পানিটিতে বড় অঙ্কের পলিসি তামাদি হয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, ২০২১ সালে কোম্পানিটি ব্যবস্থাপনা ব্যয় খাতে খরচ করেছে ২৫৩ কোটি ৪৮ লাখ ২৬ হাজার টাকা। তবে আইন অনুযায়ী বছরটিতে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা খাতে সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ছিল ২০৬ কোটি ৯৭ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। এ হিসাবে আইন লঙ্ঘন করে প্রতিষ্ঠানটি ৪৬ কোটি ৫০ লাখ ৩১ হাজার টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। আগের বছর ২০২০ সালে কোম্পানিটি ৪৩ কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যয় করে।
সবশেষ ২০২১ সালে কোম্পানিটি আইন লঙ্ঘন করে যে অর্থ ব্যয় করেছে তার মধ্যে জানুয়ারি-মার্চ সময়ে রয়েছে দুই কোটি ৫৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা। এছাড়া এপ্রিল-জুন সময়ে পাঁচ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার টাকা, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ১৪ কোটি ৮৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা এবং অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে ২৩ কোটি ৬১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা আইন লঙ্ঘন করে খরচ করা হয়েছে।
আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, জেবিসি প্রথম বর্ষের প্রিমিয়াম আয়ের ৯০ শতাংশ ও নবায়নকৃত প্রিমিয়াম আয়ের ১২ শতাংশের বেশি ব্যবস্থাপনা ব্যয় করা যাবে না। বিদ্যমান বিমা আইনেও একই কথা বলা রয়েছে। কিন্তু জেবিসি আইনকানুনের ধার ধারেনি।
গত বছরের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জেবিসির প্রথম বর্ষের প্রিমিয়াম আয় ছিল ১০৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, যার ৯০ শতাংশ ৯৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। একই সময়ে নবায়নকৃত প্রিমিয়াম আয় ছিল ৩৬০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, যার ১২ শতাংশ হলো ৪৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। সে অনুযায়ী অনুমোদিত ব্যয় ১৪০ কোটি ৯৩ লাখ টাকা হওয়ার কথা থাকলেও সংস্থাটি ব্যয় করেছে ২২০ কোটি ৬২ লাখ টাকা। অর্থাৎ বেশি ব্যয় করেছে ৭৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। একইভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরেও জেবিসি ৭৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা বাড়তি ব্যয় করেছে। এ সম্পর্কে নিরীক্ষা দলকে জেবিসি বলেছে, ২০১৫ সালের জাতীয় বেতনকাঠামো বাস্তবায়নের কারণে বাড়তি ব্যয় করতে হয়েছে।
এদিকে কোম্পানিটির বিমা দাবির চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২১ সালে কোম্পানিটি ৫৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকার বিমা দাবি পরিশোধ করেনি। এর মধ্যে গ্রাহকের মৃত্যুজনিত বিমা দাবি রয়েছে ২৭ কোটি ২১ লাখ ৩১ হাজার টাকা। এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ বিমা দাবি ২৪ কোটি ৩৯ লাখ ১৭ হাজার টাকা, সার্ভাইবেল বেনিফিটি (এসবি) এক কোটি ৯১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা এবং গ্রুপ বিমা দাবি পাঁচ কোটি ৯৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা রয়েছে
বছরটিতে বিমা দাবির টাকা না পাওয়া গ্রাহকের সংখ্যা আট হাজার ৩৬ জন। এর মধ্যে গ্রাহকের মৃত্যুজনিত বিমা দাবি এক হাজার ২৪৬টি, পলিসির মেয়াদোত্তীর্ণ বিমা দাবি ছয় হাজার ৬১৩টি, এসবি তিনটি এবং গ্রুপ বিমা দাবি ১৭৪টি।
বড় অঙ্কের বিমা দাবি অপরিশোধিত থাকার পাশাপাশি কোম্পানিটিতে মোটা অঙ্কের পলিসি তামাদি (বিমা পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই গ্রাহক প্রিমিয়ামের টাকা না দেওয়ায় পলিসি বন্ধ হয়ে যাওয়া) হয়ে গেছে। ২০২১ সালে কোম্পানিটিতে তামাদি পলিসির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৪৭০টি।
এদিকে জীবন বিমা করপোরেশনের উচ্চমান সহকারীসহ ৫১২ পদে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসসহ বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠে। নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে অন্তত ৪০ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সর্বশেষ ২০২১ সালে কোম্পানিটি আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা ব্যয় হিসেবে অতিরিক্ত খরচ করেছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। বছরের পর বছর ধরে কোম্পানিটি এভাবে অবৈধ ব্যয় করছে।
ইনস্যুরেন্স করপোরেশন অ্যাক্ট, ১৯৭৩ অনুযায়ী জেবিসির লভ্যাংশের ৫ শতাংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হওয়ার কথা। কিন্তু জেবিসি ২০০৯-১০ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে ২২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা জমা দেয়নি। সংস্থাটির চার দফা দ্বিবার্ষিক মূল্যায়নেও এ তথ্য উঠে আসে।
লভ্যাংশ জমা না করে জেবিসি বরং ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর জন্য ২৫ কোটি টাকা অনুদান চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ ব্যাপারে অর্থ বিভাগের অনুমোদন চেয়েও পায়নি। অর্থ বিভাগ বলেছে, লভ্যাংশের অংশ সরাসরি পরিশোধিত মূলধনে রূপান্তরিত হওয়ার সুযোগ নেই।
জীবন বীমা কর্পোরেশনের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমি জীবন বীমা কর্পোরেশনে নতুন যোগ দিয়েছি। ২০২১ সালের রিপোর্টটি আমি এখনও দেখিনি। আমরা অবশ্যই খরচ কমানোর চেষ্টা করবো।
বিমা দাবি বকেয়া থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিমা দাবি পরিশোধ করি। যেসব বিমা দাবি বকেয়া আছে সেগুলো পরিশোধের জন্য আমি এসেই উদ্যোগ নিয়েছি। যেগুলো দুই মাস, তিন মাস, ছয় মাস বকেয়া আছে, সেগুলো আমরা চিহ্নিত করছি। তিন বছরের ওপরে যে দাবিগুলো বকেয়া আছে, সেগুলো কেন অনিষ্পন্ন তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। দরকার হলে গ্রাহক সমাবেশ করে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশে অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে এবং দিনে দিনে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির ব্যবহার কোথায় হচ্ছে এবং কারা ভোগ করছে, তা সঠিকভাবে বণ্টন হচ্ছে কি না ইত্যাদি বিষয় জনগণের বৃহত্তর স্বার্থেই সংশ্লিষ্ট সবার ভালোভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করলেও সমাজের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি থাকায় এর সুফল জনগণ সঠিকভাবে পাচ্ছেন না। তবে দুর্নীতি না থাকলে আমাদের দেশ অনেক আগেই মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশ হয়ে উঠত, সে কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে।
তারা বলেন, বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের সবার প্রিয় এ দেশে যত সমস্যা জাতীয় উন্নয়ন-অগ্রগতি, ন্যায়বিচার ও সুশাসনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং দাঁড়াচ্ছে, দুর্নীতি তার মধ্যে অন্যতম। জনসংখ্যাধিক্য ও ক্ষুদ্র আয়তনের এ দেশটির একদিকে যেমন বিরাজ করছে সম্পদের অভাব, তেমনি অপরদিকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিরাজ করছে দুর্নীতির কালো ছায়া।
দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখানো; দুদককে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং অবাধ গণমাধ্যম ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।
পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে তাদেরকে শুধু ‘দুর্নীতিবাজ’ হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করাসহ তাদেরকে সামাজিকভাবে বর্জন করার ব্যবস্থা করা দরকার।
তারা আরও বলেন, দুর্নীতি রোধের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সংস্কার, সুশীল সমাজ গঠন, ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে দুর্নীতির প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন ও তা দূর করতে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করাও আবশ্যক। এ ছাড়া গণমাধ্যমকে প্রকৃত অর্থেই স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির সুযোগ করে দেওয়া, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় সম্পৃক্ততা বিচ্ছিন্ন করা এবং সর্বক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটানো জরুরি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১৩
আপনার মতামত জানানঃ