অনেক জানা-অজানা কারণে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার মধ্যে অন্যতম জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ভারী ও মাঝারি শিল্প স্থাপন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও বন উজাড়, কৃষিতে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকের ব্যবহার, কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন, কাঠ পুড়িয়ে ইট উৎপাদন, পরিবহন থেকে উত্পন্ন ধোঁয়া ও শব্দ।
বাংলাদেশের অবস্থা বিবেচনা করলে জনসংখ্যা আমাদের জন্য বিশাল চাপ। বাড়তি জনসমষ্টির জন্য খাবার, পরিধেয় ও বাসস্থান জোগাড় করতে গিয়ে কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। যেখানে সেখানে শিল্প স্থাপনের ফলে চারপাশের মাটি, বাতাস ও পানি দূষিত হয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা না করে মাদারীপুরে জনবসতি ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ছোট–বড় স্বয়ংক্রিয় ১৭টি চালকল (অটো রাইস মিল)। এসব চালকলের বর্জ্যে নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি, দূষিত হচ্ছে খালবিল, নদী। চালকলের ধোঁয়া ও ছাইয়ে গাছপালার পাতা পর্যন্ত কালো হয়ে গেছে। গাছে ফল ধরে না। এলাকার বয়স্ক ও শিশুরা ভুগছেন শ্বাসকষ্টে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তথ্য বলছে, জেলায় অনুমোদিত স্বয়ংক্রিয় ১০টি বড় চালকল রয়েছে। এর মধ্যে রাজৈর উপজেলায় সাতটি, কালকিনিতে দুটি ও সদরে একটি চালকল রয়েছে। মালিকেরা নিজ উদ্যোগে চালকল স্থাপনের পর খাদ্য অধিদপ্তরে আবেদন করেই উৎপাদন শুরু করেন।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলায় ছোট–বড় মিলিয়ে স্বয়ংক্রিয় ২০টি চালকল রয়েছে। সদর ও কালকিনির ৩টি কারখানা ছাড়া বাকি ১৭টির একটিও পরিবেশের নিয়মনীতি মেনে স্থাপন করা হয়নি। এ কারণে কারখানার গরম পানি, ছাই ও দূষিত বর্জ্যে আবাদি জমি ও নদীদূষণ হচ্ছে।
রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের তাঁতিকান্দি গ্রামে গত দুই বছরে মেসার্স জবেদা অটোরাইস মিল, মেসার্স রোকেয়া অটোরাইস মিল, মেসার্স জননী অটোরাইস মিল ও মেসার্স পলাশ অটোরাইস মিল নামে বড় বড় চারটি কারখানা স্থাপন করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এ ছাড়া এ গ্রামেই আছে ছোট আরও তিনটি স্বয়ংক্রিয় চালকল।
২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর হোসেনপুর ইউনিয়নের মাতুব্বরবাড়ি এলাকার ঘনবসতি ও ফসলি জমির মধ্যে গড়ে ওঠা জননী অটো রাইস মিলের যাত্রা শুরু হয়। মিলটির উদ্বোধন করেন মাদারীপুর-২ আসনের সাংসদ শাজাহান খান। চালকলটির চারপাশে ফসলি জমি। জমির মাঝখানে হওয়ায় গরম পানি, ছাই ও দূষিত বর্জ্য ফেলা হয় চালকলের পেছনের একটি খোলা জায়গায়। এ ছাড়া রাজৈর উপজেলার কামালদী এলাকার মেসার্স সাদিয়া এন্টারপ্রাইজ অটো রাইস মিল, নয়াকান্দি এলাকার মেসার্স রতন অটো রাইস মিলসহ অন্তত ১০টি চালকলের বর্জ্যের কারণে ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেও কোনো কাজ হয়নি বলে ভুক্তভোগীরা জানান।
মাতুব্বরবাড়ি এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাই উড়ে অস্থির একটা অবস্থার মধ্যে আছি আমরা। জমিজমা সব শ্যাষ। রাতদিন শব্দের সমস্যা তো আছেই। ধুলাবালিতে কানা হয়ে যায় সব। দুই বছর ধরে নরক যন্ত্রণায় আছি আমরা।’
তথ্য অধিকার আইনে জানতে চাইলে মাদারীপুর খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে বলা হয়, চালকল করতে প্রথমে মালিক জমি নির্ধারণ করে কল স্থাপন করেন। পরে দলিলের কপি, বিদ্যুৎ বিলের কপি, পরিবেশের ছাড়পত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের নির্ধারিত প্রকৌশলীর কাছে আবেদন করতে হয়।
মালিকেরা নিজ উদ্যোগে চালকল স্থাপনের পর খাদ্য অধিদপ্তরে আবেদন করেই উৎপাদন শুরু করেন।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর, ফরিদপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক এ এইচ এম রাশেদ প্রথম আলোকে বলেন, তিন-চারটি অটো রাইস মিলের ছাড়পত্র আছে। কয়েকটার আবেদন করা আছে। তবে যারা ছাড়পত্র নিয়েছেন তাদের বেশির ভাগই নবায়ন করছেন না। মিলগুলো সময়ের অভাবে পরিদর্শন করা হয়নি।
এদিকে ফসলি জমি ও লোকালয়ে চালকল করার ছাড়পত্র দেওয়ার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরকে দায়ী করছে খাদ্য অধিদপ্তর। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘পরিবেশের ক্ষতি হলে তা দেখার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। তারাই পদক্ষেপ নেবে। তা ছাড়া পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া একটি অটো রাইস মিলেরও অনুমোদন দেয় না খাদ্য বিভাগ।’
জানতে চাইলে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে ফসলি জমি ও নদীদূষণ করে কোনো প্রতিষ্ঠান চালানো যাবে না। যারা এসব চালকল চালাচ্ছেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই কারখানার মালিককে সতর্ক করা হবে। তারপরও নির্দেশনা না মানলে নিয়ম ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলেন, কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ফসলি জমি থেকে খাদ্যচক্রের বিষক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগের সৃষ্টি করে। তাই সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী, কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্য ইটিপিতে শোধনের পরই যাতে নির্গত করা হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
এমনকি যেসব কারখানা তা অমান্য করে পরিবেশ দূষণ করবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিও জানান তারা।
তারা মনে করেন, সুষ্ঠু ও সমন্বিত উদ্যোগ, বিশেষত জলাধার সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণে জনসচেতনতা, নির্বিচারে ভরাট না করা, জনপ্রতিনিধিদের নজরদারি প্রভৃতি উদ্যোগ নেয়া হলে আমাদের দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন হওয়া থেকে বাঁচবে।
তারা বলেন, পরিবেশ দূষণ হ্রাস ও পরিবেশের উন্নয়নে অনেক পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এর মধ্যে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ, পলিথিন-প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিত করা, কলকারখানায় ইটিপি চালানো বাধ্যতামূলক করা, কৃষিতে রাসায়নিক সার, বালাইনাশক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে জৈব সার, বালাইনাশকের ব্যবহারে উৎসাহিত করা, পরিবেশ আইন অনুসরণ করতে বাধ্য করা।
যেমন বিল্ডিং কোড, কারখানা স্থাপনের জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র, পরিবেশের ক্ষতি হয় কিনা তার রিপোর্ট (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট—ইআইএ) ঠিকমতো করেছে কিনা, তা যাচাই করা। সব ধরনের ময়লা (গ্রহ উৎপাদিত, মানববর্জ্য) ইত্যাদির সঠিক অপসারণ, সংরক্ষণ এবং প্রয়োজনে পুনঃউৎপাদন করা। উদাহরণস্বরূপ, যশোর সিটি করপোরেশন শহরের সব ময়লা কেন্দ্রীয় শোধনাগারে এনে তা প্রক্রিয়া করে বায়োগ্যাস ও কম্পোস্ট তৈরি করছে। যাদের কাছ থেকে ময়লা নেয়া হয়, তারাই আবার অর্থের বিনিময়ে জৈব সার কিনে কেন। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো, যেমন গ্রিন বিল্ডিংয়ের পরিমাণ বাড়ানো। সম্প্রতি আরেকটি পরিবেশের প্রতি ইতিবাচক চর্চা বাংলাদেশে শুরু হয়েছে, সেটা টেকসই উন্নয়ন অর্থাৎ সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট; পরিবেশবান্ধব নির্মাণ বা গ্রিন বিল্ডিং নামে সমধিক পরিচিত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০৮
আপনার মতামত জানানঃ