পাহাড় কাটা বা বনাঞ্চল ধ্বংস করা নিত্যদিনের ঘটনা। দিনের পর দিন সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে পাহাড় কাটলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় এখনো বন্ধ হয়নি অবৈধভাবে পাহাড় কাটা। পরিবেশকর্মীরা বারবার বিষয়টি প্রশাসনের নজরে এনে পাহাড় কাটা বন্ধের আহ্বান জানালেও এ বিষয়ে নিয়মিত অভিযান ও নজরদারি নেই প্রশাসনের। কেননা এসব পাহাড় কাটার পেছনে রয়েছেন জনপ্রতিনিধি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
কক্সবাজারের উখিয়ায় দিনদুপুরে বুলডোজার ও খননযন্ত্র দিয়ে একটি পাহাড় মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি না নিয়েই পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ ধ্বংসযজ্ঞে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, মুজিব বর্ষে সরকার ঘোষিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের জন্য সরকারি মালিকানাধীন প্রায় ৬০ ফুট উচ্চতার পাহাড়টি কেটে সমতল ভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। সেখানে আম, পেয়ারা ও কলার বাগান ছিল। পাহাড় কাটা মাটি দিয়ে চেয়ারম্যানের ব্যক্তিমালিকানাধীন বাজার ও পাশের থাইংখালী খাল ভরাট করা হচ্ছে।
দেখা গেছে, ৫০-৬০ ফুট উঁচু বিশাল একটি সরকারি পাহাড় কেটে সমতল ভূমি বানিয়ে ফেলা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই জায়গায় স্থানীয় কয়েকজন মানুষ আম, পেয়ারা ও কলার বাগান করতেন। এখন সে জায়গাতেই ইটের গাঁথুনি তোলা হচ্ছে। আবার পাহাড় কাটা মাটি ফেলে চেয়ারম্যানের ব্যক্তিমালিকানাধীন বাজার ও পাশের থাইংখালী খালও ভরাট করতে দেখা গেছে।
স্থানীয় লোকজনের মধ্যে অনেকের দাবি। পাহাড়টি বন বিভাগের মালিকানাধীন। তবে বন বিভাগ এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকায় আছে। আবার অনেকে বলছেন, পাহাড়টি সরকারি ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত। তবে ওই পাহাড় সরকারি খাসজমি কিংবা বন বিভাগের মালিকানাধীন, যেটাই হোক না কেন, এভাবে পাহাড় কেটে আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণের ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষই বিরোধিতা করেছেন।
নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি পাহাড় কাটতে গেলে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি লাগে। কিন্তু পালংখালীতে পাহাড় কেটে আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণের বিপরীতে কেউ পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করেননি।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিদর্শক মাহবুবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি পাহাড় কাটতে গেলে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি লাগে। কিন্তু পালংখালীতে পাহাড় কেটে আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণের বিপরীতে কেউ পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করেননি।
মাহবুবুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় ব্যক্তিদের অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি গতকাল দুপুরে সরেজমিনে স্থানটি পরিদর্শন করেছেন। বিশাল পাহাড় কেটে সেখানে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ চলছে। সেটাও আবার জাতির জনকের নামে। আবার পাহাড় কাটা মাটি দিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান নিজের বাজার ও বাজারের পাশে একটি খালও ভরাট করছেন। চেয়ারম্যান পাহাড় কাটা মাটি বিক্রি করেছেন, এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরীর ভাষ্য হচ্ছে, হাজার হাজার একরের সরকারি পাহাড় কেটে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আশ্রয়শিবির করা গেলে স্থানীয় গরিব লোকজনের জন্য কেন আশ্রয়ণ প্রকল্প করা যাবে না? উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরেজমিনে এসে আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণের জন্য সরকারি পাহাড়টি চিহ্নিত করে দিয়েছেন। ইউএনও নজিম উদ্দিন আহমেদ বলছেন ভিন্ন কথা।
তিনি বলেন, পালংখালীর খাসজমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু পাহাড় কেটে সেই আশ্রয়ণ প্রকল্প হচ্ছে কি না, সেটা তার জানা নেই।
বন বিভাগ বলছে, পাহাড়টি তাদের আওতাধীন নয়। পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, কেউ তাদের অভিযোগ জানায়নি।
গত কয়েক দশকে কক্সবাজারে বনভূমি দখলের পাশাপাশি নির্বিচার পাহাড় নিধন চলছেই। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেওয়ার পর পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়েছে। প্রভাবশালীদের অনেকেই বনভূমি দখল ও পাহাড় কাটার কাজে যুক্ত হয়েছেন। এ কাজে প্রশাসনের যোগসাজশের খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বাড়তি জনচাপে এমনিতেই কক্সবাজারের পরিবেশ ও প্রকৃতি ভয়াবহ হুমকির মুখে। চেয়ারম্যানের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে প্রভাবশালীরা পাহাড় কাটা কিংবা বনভূমি ধ্বংসের ব্যাপারে আইনকানুনের তোয়াক্কা করেন না।
সমুদ্র, নদী, পাহাড়ের মেলবন্ধন রয়েছে চট্টগ্রামে। প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যের নগরীর পাহাড়গুলো একে একে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রভাবশালী ভূমিপুত্রদের কুনজরে হারিয়ে যাচ্ছে বেশিরভাগ পাহাড়। কেউ কাটছে কৌশলে, কেউ কাটছে দিনদুপুরে কিংবা রাতে।
চট্টগ্রাম নগরীতে এ ধরনের অসংখ্য পাহাড়ের একটি বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার নাগিন পাহাড়। পরিবেশ অধিদপ্তর জরিমানা করে দায় সারলেও ঠেকানো যাচ্ছে না পাহাড় কাটা। আবার ধসে পড়া মাটিও রাতের আঁধারে সরিয়ে নেয় প্রভাবশালী এবং দুষ্কৃতকারীরা। এভাবে নাগিন পাহাড়ের আশেপাশে পাহাড়ি ভূমিতে তৈরি হচ্ছে একে একে অট্টালিকা।
২০১১ সালে চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা নিয়ে ‘হিল কাটিং ইন অ্যান্ড অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, বেশিরভাগ পাহাড় কাটা হয় পাহাড়তলী, খুলশী, বায়েজিদ, লালখান বাজার মতিঝর্ণা, ষোলশহর এবং ফয়’স লেকে।
১৯৭৬ থেকে ৩২ বছরে চট্টগ্রাম নগর ও আশেপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ১৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয় বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। ১৯৭৬ সালে নগরের পাঁচ থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে হয় ১৪ দশমিক ০২ বর্গকিলোমিটার। এ সময় ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়। এটা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ। নগরের বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালি ও পাহাড়তলী থানা এলাকায় এসব পাহাড় কাটা হয়। সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ কাটা পড়ে পাঁচলাইশে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, চট্টগ্রাম এলাকায় বর্ষাকালে প্রাণঘাতী ভূমিধস ও কাদার প্রবাহ নেমে আসার প্রধানতম কারণ হলো পাহাড় কাটা। এর বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগের বিষয়ে ঔদাসীন্য রয়েছে। এ ঔদাসীন্য কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন।
তারা বলেন, চট্টগ্রামের ঐতিহ্য পাহাড়। কিন্তু প্রশাসন ও বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়হীনতার কারণে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো দিন দিন দখলে গিয়ে বিলাসবহুল প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। কেউ দখল করে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে ভাড়া দিচ্ছে। আবার কেউ আবাসন প্রকল্পের নামে পাহাড় কেটে সুউচ্চ আবাসন ভবন তৈরি করে চড়া দামে বিক্রি করছে।
এ পাহাড়ের ওপর প্রকল্পগুলোর নকশা সিডিএ কিভাবে অনুমোদন দেয়, সেটাই অন্ধকারে রয়ে গেছে। নগরীর সৌন্দর্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পাহাড় সংরক্ষণ করা জরুরি।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, পাহাড় ও বন কাটার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের মাঝেমধ্যে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বা পরিবেশ আদালতে মামলা করেই যেন পরিবেশ অধিদপ্তর দায়িত্ব শেষ। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং পাহাড় ধ্বংসকারীদের আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। জরিমানা ছাড়াও পাহাড় বেষ্টনী দিয়ে বনায়ন করতে হবে।
তারা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, সেগুলোতে একই অপরাধ বারবার হলে শাস্তির মাত্রা কয়েক গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পরিবেশ আইনে যদি এমন দুর্বলতা থাকে, তাহলে তা দূর করা এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে পরিবেশ ধ্বংসকারী দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ দ্রুতই পাহাড়শূন্য হয়ে যাবে, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল বলে কিছু থাকবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মুজিব বর্ষে গৃহহীনদের ঘর দেওয়ার সরকারি যে উদ্যোগ, তা নিঃসন্দেহে মহতী ও দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী উদ্যোগ। কিন্তু এ কাজে কেন পাহাড় কাটতে হবে? এটা সুস্পষ্টভাবে পরিবেশ আইনের লঙ্ঘন। এতে সরকারের উদ্যোগটাও বিতর্কিত হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, আশ্রয়ণ প্রকল্পের জন্য আর কোথাও কি খাসজমি ছিল না? সবার সামনে একটা প্রাকৃতিক পাহাড় কেটে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা ইউএনও সেটা জানেন না—এমন যুক্তি দিয়ে কি দায় এড়াতে পারে? নির্বিচার পাহাড় কাটার ফলে প্রতিবছর ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। কৃতকর্মের জন্য ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের কার গাফিলতিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তা-ও তদন্ত করে বের করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৫
আপনার মতামত জানানঃ