করোনার কারণে বিশ্বে সম্ভবত ১ কোটি ৮০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে এক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে। এ সংখ্যা করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী সরকারগুলোর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে তিনগুণেরও বেশি।
বিশ্বের ১৯১টি দেশ ও অঞ্চলের বিভিন্ন সরকারি ওয়েবসাইট, ওয়ার্ল্ড মর্টালিটি ডাটাবেস, হিউম্যান মর্টালিটি ডাটাবেস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের বিজ্ঞানীরা। আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেটে বৃহস্পতিবার ছাপাও হয়েছে সেই প্রতিবেদন। শুক্রবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণাটি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক। বিশ্ববিদ্যালয়টির অ্যাকসেস মর্টালিটি টিম (অতিরিক্ত মৃত্যুহার দল) ১৯১টি দেশ ও অঞ্চলের তথ্য পর্যালোচনা করেছেন। তারা এটিকে প্রকৃত বৈশ্বিক মৃত্যুর সংখ্যা বলছেন। এসব মৃত্যুর কিছু হয়েছে ভাইরাসে, অন্য মৃত্যুগুলো সংক্রমণ সংশ্লিষ্ট কারণে। কারণ কো-মরিবিডিটি তথা আগে থেকে গুরুতর রোগে আক্রান্তদের করোনা গুরুতর হয়। যেমন— হৃদরোগ বা ফুসফুসের রোগ।
এই হিসাব বের করতে গবেষকরা বিভিন্ন সরকারি ওয়েবসাইট, ওয়ার্ল্ড মর্টালিটি ডাটাবেজ, হিউম্যান মর্টালিটি ডাটাবেজ ও ইউরোপিয়া স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিসের পরিসংখ্যান থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
দুই বছর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) আনুষ্ঠানিকভাবে করোনা মহামারির ঘোষণা দেয়। নতুন গবেষণায় উল্লেখিত মৃতের সংখ্যাটি পুরো মহামারি পর্বের।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল ১৯১টি দেশ ও অঞ্চলের কোভিড-১৯ এ মৃত্যুর সংখ্যা সংগ্রহ ও এ নিয়ে গবেষণা করে।
এসব মৃত্যুর মধ্যে বেশ কিছু সরাসরি করোনা ভাইরাসের কারণে; বাকি মৃত্যুগুলো করোনার কারণে সৃষ্ট সংক্রমণের জেরে। অর্থাৎ পরিসংখ্যানে করোনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মৃত্যু অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
গবেষকরা করোনা আক্রান্তদের সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট জটিলতা এবং এর কারণে মৃত্যুকে মোট মৃত্যুর অন্তর্ভূক্ত করেছেন।
উদাহরণ হিসেবে তারা বলছেন, আগে থেকে থাকা শারীরিক সমস্যাকে কোভিড আরও খারাপের দিকে নিয়ে গেছে; যেমন ফুসফুস ও হার্টের জটিলতাকে আরও বাড়িয়েছে।
গবেষকরা এসব জটিলতায় মৃত্যুকেও করোনার প্রভাবে মৃত্যুর তালিকাভূক্ত করেছেন। এছাড়া কোভিড মহামারিপূর্ব বছরগুলোতে মৃত্যুর হারও এ গবেষণায় বিবেচনায় আনা হয়েছে।
পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশ ও অঞ্চলভেদে মৃত্যুর এ সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমবেশি হয়েছে। তবে এক গড় হিসেবে দেখা গেছে, করোনা বিশ্বব্যাপী প্রাণ কেড়ে নিয়েছে প্রতি ১ লাখে ১২০ জনের।
সে হিসেবে ২০২০ সালে মহামারি শুরুর পর ২০২১ সাল পর্যন্ত দুই বছরে কোভিডে প্রাণ গেছে ১ কোটি ৮২ লাখ মানুষের, যা প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে অন্তত তিনগুণ বেশি।
একই সময়সীমায় করোনা মহামারিতে বিশ্বব্যাপী ৫৯ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন দেশের সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে।
গবেষকরা কয়েকটি দেশের কথা উল্লেখ করেছেন যেগুলোতে প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা অন্য দেশগুলোর চেয়ে আরও অনেক বেশি দেখেছেন।
এ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- বলিবিয়া, বুলগেরিয়া, ইসওয়াতিনি, উত্তর মেসিডোনিয়া, লেসেথো। এ ক্ষেত্রে নিচের সারিতে রয়েছে- আইসল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ড, তাইওয়ান।
২০২০ সালে মহামারি শুরুর পর ২০২১ সাল পর্যন্ত দুই বছরে কোভিডে প্রাণ গেছে ১ কোটি ৮২ লাখ মানুষের, যা প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে অন্তত তিনগুণ বেশি।
দাপ্তরিক হিসেব অনুযায়ী, মহামারির গত দু’ বছরে বিশ্বজুড়ে করোনায় মারা গেছেন ৫৯ লাখের কিছু বেশি সংখ্যক মানুষ; কিন্তু ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে মহামারি শুরুর পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সংক্রমণ পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতি বা অবনতি হওয়া সত্ত্বেও গড় হিসেবে গত দু’বছরে বিশ্বে প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে কোভিডে মারা গেছেন ১২০ জন।
গবেষণা প্রবন্ধে আরও বলা হয়, লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ ও আফ্রিকার সাব সাহারা অঞ্চলের নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে করোনায় মৃত্যু হার বেশি; কিন্তু ইতালি, যুক্তরাষ্ট্রের মতো কয়েকটি ধনী দেশেও ব্যাপক সংখ্যক মৃত্যু হয়েছে কোভিডজনিত কারণে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের ভাষ্য অনুযায়ী, বলিভিয়া, বুলগেরিয়া, এসওয়াতিনি, উত্তর মেডিডোনিয়া ও লেসোথো— এই ৫ দেশে করোনায় মৃত্যু হয়েছে সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে আইসল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ড ও তাইওয়ানে মৃত্যু হয়েছে সবচেয়ে কম।
গবেষকরা জানান, মুষ্টিমেয় যে কয়েকটি দেশে করোনায় মৃত্যু সম্পর্কিত সরকারি তথ্য ও প্রকৃত সংখ্যার মধ্যে সাদৃশ্য পাওয়া গেছে সেসবের মধ্যে অন্যতম যুক্তরাজ্যে। গত দুই বছরে দেশটিতে প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে কোভিডে। অর্থাৎ, গড় হিসেবে দেশটিতে প্রতি ১ লাশ মানুষের মধ্যে ১৩০ জন মারা গেছেন এই রোগে আক্রান্ত হয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই গবেষক দলের নেতা ও ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ইন্সটিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন বিভাগের অধ্যাপক হাইডং ওয়াং বিবিসিকে বলেছেন, জনস্বাস্থ্য সম্পর্তিক পরিকল্পনা সাজাতে মহামারীতে মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা জানাটা জরুরি।
তিনি আরও বলেন, ‘সুইডেন, নেদারল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, সেসব দেশে ‘অতিরিক্ত মৃত্যুর’ প্রধান কারণ কোভিড। তবে বিশ্বের অনেক দেশের নির্ভরযোগ্য তথ্য আমাদের হাতে নেই।’
‘আমরা মনে করি, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বে কত সংখ্যক অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটেছে— সে বিষয়ক পরিপূর্ণ তথ্য উদ্ঘাটণ করতে হলে আরও গবেষণা প্রয়োজন।’
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে করোনাভাইরাস শনাক্তের পর ২০২০ সালের ১১ মার্চ রোগটিকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই হিসাবে মহামারি ঘোষণার দুই বছর পূর্তি হয় শুক্রবার (১১ মার্চ)।
ল্যানসেটে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে, অতিরিক্ত মৃত্যুর সর্বোচ্চ হার ছিল লাতিন আমেরিকার নিম্ন আয়ের দেশ, ইউরোপ ও সাব-সাহার আফ্রিকার। তবে মৃত্যুহার মোটামুটি বেশি ছিল ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অংশের মতো উচ্চ আয়ের দেশে।
প্রাক্কলিত অতিরিক্ত মৃত্যুহার সর্বোচ্চ থাকা ৫টি দেশ হলো- বলিভিয়া, বুলগেরিয়া, এসওয়াতিনি, নর্থ মেসিডোনিয়া ও লেসেথো।
সর্বনিম্ন হারের ৫টি দেশের মধে রয়েছে- আইসল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, নিউ জিল্যান্ড ও তাইওয়ান।
গবেষণা প্রতিবেদনের প্রধান লেখক ইন্সটিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন-এর গবেষক হাইডং ওয়াং বলেন, কার্যকর জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সিদ্ধান্তের জন্য মহামারিতে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ। সুইডেন ও নেদারল্যান্ডসসহ বিভিন্ন দেশের তথ্য গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া গেছে অতিরিক্ত মৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণ ছিল করোনাভাইরাস। কিন্তু বেশিরভাগ স্থানে পর্যাপ্ত তথ্য এখন আমাদের কাছে নেই।
তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে আরও গবেষণার মাধ্যমে জানা যাবে করোনায় প্রত্যক্ষভাবে কত মৃত্যু হয়েছে এবং মহামারির পরোক্ষ প্রভাবে কতজন মারা গেছেন।
গবেষকরা ধারণা করছেন, মহামারি সংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত মৃত্যুহার কমতে থাকবে টিকা ও নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির কারণে।
কিন্তু তারা সতর্ক করে বলছেন, মহামারি এখনও শেষ হয়নি। করোনার নতুন ও বিপজ্জনক ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব হতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১১৫৫
আপনার মতামত জানানঃ