পুরুষের ওপর নির্ভর হয়ে থাকতে চান না অনেক নারী। তারা একা থাকতে চান। নিজের জীবন এবং সময়কে নিজের মতো করে সাজাতে চান। জীবনকে উপভোগ করতে চান।
রাজধানীতে এখন কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন নারী। কিন্তু তাদের নিরাপদ আবাসন সীমিত। শহরে একজন পুরুষের বাড়ি ভাড়া পাওয়া যতটা সহজ, নারীর জন্য তা ততটা সহজ নয়।
কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি তাদের আবাসন সুযোগ, ফলে পদে পদে হয়রানি ও নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে দেশের শহরকেন্দ্রিক কর্মজীবী নারীদের।
দেশের মোট সাতটি সরকারি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে আবাসন সুবিধা আছে মাত্র দুই হাজার ১৪৪ জনের। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় রয়েছেন অবিবাহিত, বিধবা অথবা বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে একা জীবনযাপন করা কর্মজীবী নারীরা।
ভুক্তভোগীরা বলছেন নারীদের পুরুষ শিক্ষার্থী বা কর্মজীবীদের মতো কয়েকজন মিলে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকার সুযোগ না থাকায় একা বসবাসকারী মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক আবাসনের সন্ধান করা ছাড়া উপায় থাকে না।
অন্য দিকে নারী হোস্টেল সংখ্যায় কম থাকায় বেসরকারি হোস্টেল মালিকেরা বেশি ভাড়া আদায়ের সুযোগ পাচ্ছে।
তবে একাধিক ভবন মালিক জানান, চাহিদা থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ বাড়িওয়ালা নিরাপত্তাজনিত কারণে মেয়েদের হোস্টেল বানাতে সাহসী হন না। এই নিরাপত্তার অজুহাতেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেন বেসরকারি নারী হোস্টেলের মালিকরা।
কয়েকজন কর্মজীবী নারী অভিযোগ করে বলেন, ‘দ্রুত সিট ভাড়া বেড়ে যাচ্ছে। অনেক স্থানে শক্ত লবিং ছাড়া সিট পাওয়া যায় না। ’ এ ছাড়া অভিযোগ আছে অস্বাস্থ্যকর খাবারেরও।
রাজধানীতে একজন কর্মজীবী সিঙ্গেল নারীকে আবাসনের পেছনে একক পুরুষের তুলনায় গড়ে প্রায় দ্বিগুণ, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তিন গুণ খরচ বহন করতে হয়।
কর্মজীবী নারীরা বলছেন, কর্মজীবী একক পুরুষ যত সহজে আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারেন বা তাদের বেছে নেওয়ার যতটা সুযোগ থাকে, নারীদের বেলায় তা থাকে না। আবাসন সমস্যা সমাধানে তাদের নানা ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হয়।
জানা যায়, রাজধানীতে পুরুষ শিক্ষার্থী বা কর্মজীবীরা কয়েকজন মিলে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকার (মেসিং) সুযোগ পেলেও নারীরা এই সুযোগ সহজে পান না। তাদের হোস্টেল ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক আবাসনের দ্বারস্থ হতে হয়। রাজধানীতে নতুন নতুন হোস্টেল গড়ে উঠছে বটে, তবে চাহিদার তুলনায় তা অনেক কম। সরকারি উদ্যোগে ঢাকায় নারী হোস্টেল আছে মাত্র তিনটি। রাজধানীর ১০টি বেসরকারি নারী হোস্টেলে বসবাসকারী নারীদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, তারা মনে করেন, নারীদের আবাসন সংকট কাজে লাগিয়ে হোস্টেল মালিকরা খরচ বাড়িয়ে দেন। তবে মালিক ও তত্ত্বাবধায়করা বলেছেন, নারীদের হোস্টেলে বাড়তি নিরাপত্তা ও নজরদারি রাখতে হয়। এ জন্য ভাড়া কিছুটা বাড়তি থাকে।
উম্মে শায়লা রাজবাড়ী থেকে মাস্টার্স শেষ করে গত জানুয়ারি মাসে ঢাকায় আসেন। ওঠেন এক আত্মীয়র বাসায়। ফেব্রুয়ারি মাসেই বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে তার চাকরির সুযোগ হয়। এরপরই স্বাধীনভাবে থাকার ইচ্ছা।
মিরপুরে ছোট্ট একটা রুম ভাড়া নেন শায়লা। নিউজবাংলাকে বলেন, বাসা ভাড়া নিতে তাকে বাড়িওয়ালার নানান প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাড়িওয়ালাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। বলেছেন, ‘আমি বিপদের কারণ নই, দুই মাস পরীক্ষামূলক থাকার সুযোগ দিয়ে দেখুন।’
কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি তাদের আবাসন সুযোগ, ফলে পদে পদে হয়রানি ও নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে দেশের শহরকেন্দ্রিক কর্মজীবী নারীদের।
শায়লার মতোই তাসনুভা চৌধুরীও এই শহরে থাকছেন নারীদের একটি মেসে। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন এক বছর।
ফার্মগেটের রাজাবাজারে থাকা তাসনুভা বলেন, ‘তিন রুমের একটি ফ্ল্যাটে আমরা চার কর্মজীবী নারী থাকি। বাড়িওয়ালা মেয়েদের ভাড়া দেবেনই না। কেন দেবেন না, জানতে চাইলে নানান যুক্তি দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরাই জয়ী হই। প্রায় এক বছরে ভালোই আছি।’
শায়লা ও তাসনুভার মতো নারীদের ঘুরে দাঁড়াবার অনেক গল্পই এখন স্পষ্ট।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মেয়েদের হোস্টেল পরিচালনার জন্য আলাদা কোনো নীতিমালা নেই। ১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ও সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী হোস্টেলের বাসিন্দাদের ভাড়া নির্ধারিত হওয়ার কথা। তবে তা মানা হচ্ছে না। রাজধানীতে মাদার তেরেসা হোমস নামের একটি হোস্টেলের কার্যক্রম আছে গোটা ঢাকা শহরে। তাদের পাঁচটি হোস্টেল। ধানমণ্ডি এলাকায় ওই প্রতিষ্ঠানে একজন নারীকে একটি শয্যার জন্য খরচ করতে হয় প্রতি মাসে পাঁচ হাজার ২০০ টাকা। আবার মালিবাগে ওই হোস্টেলের শাখায় থাকতে খরচ চার হাজার ৭০০ টাকা।
বেসরকারি সংগঠন ‘কর্মজীবী নারী’র নির্বাহী পরিচালক শিরীন আখতার বলেন, ‘আমরা গার্মেন্টের কর্মজীবী নারীদের ওপর পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, তাদের আবাসন খরচ পুরুষদের থেকে বেশি। এমন বৈষম্য হওয়া উচিত নয়। ’
সরকারি হোস্টেলে আসন পেতে অবিবাহিত, বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে এমন (কিছু ক্ষেত্রে শিথিলযোগ্য) বোর্ডারকে অন্তত স্নাতক এবং ১৮-৫৯ বছর বয়সী হতে হবে। বেতন হতে হবে ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেলের ১৭তম ধাপ বা সমমানের। অর্থাৎ মূল বেতন অন্তত ৯ হাজার টাকা হতে হবে।
হোস্টেলগুলোতে একক থেকে চারজনের ঘর আছে। নিবাসীর সংখ্যা অনুযায়ী থাকা ও খাওয়া মিলিয়ে মাসিক খরচ পড়ে ১ হাজার ১০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে।
এখানে নিরাপত্তা নিয়ে অভিযোগ নেই, তবে বাসিন্দারা খাবারের মান নিয়ে অভিযোগ করেন। শৌচাগারের অবস্থাও ভালো নয়। সন্তানসহ থাকার সুযোগ নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য সরকারকে হোস্টেল বাড়াতে হবে। বেসরকারি খাতকেও এক ঘরের ফ্ল্যাট বানানোর প্রকল্প নিতে হবে। প্রয়োজনে সরকার এসব প্রকল্পে ভর্তুকি দেবে।
তারা বলেন, ‘কর্মজীবী নারীর আবাসন সুবিধা সম্প্রসারণের জন্য আরো বড় উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
কর্মজীবী নারী, বিশেষত যেসব নারী একা জীবন-যাপন করেন তাদের আবাসনের সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে যুক্ত জানিয়ে তারা বলেন, ‘সমাজে একজন নারী প্রয়োজনে একা বাস করবেন এবং নারী একাই নিরাপদ; এই নিশ্চয়তা রাষ্ট্রকেই দিতে হবে।
পুরুষের মতো নারীরও নির্বিঘ্নে একাকী বাস করার নিঃশঙ্ক পরিবেশ তৈরি হলে তাদের আবাসন সমস্যা আজ প্রকট হতো না’।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৫৮
আপনার মতামত জানানঃ